মেট গালার কার্পেটের রং ‘লাল না হয়ে নীল হলো কেন’? জেনেনিন এবার কেন এই সিদ্ধান্ত?

ফ্যাশন দুনিয়ার অন্যতম জাঁকজমকপূর্ণ এবং বহুল প্রতীক্ষিত আয়োজন হলো মেট গালা। বাংলাদেশ সময় গত ৬ এপ্রিল ভোরে অনুষ্ঠিত এবারের আসরেও হলিউড থেকে বলিউড পর্যন্ত বিশ্বের সেরা তারকারা এক ছাদের নিচে মিলিত হয়েছিলেন। রেড কার্পেটে তাদের ঝলমলে উপস্থিতি মুগ্ধ করেছে বিশ্বকে। তবে এবারের আয়োজনে গালিচার রং চিরাচরিত লাল ছিল না। বরং দর্শকদের চমকে দিয়ে কার্পেট সেজেছিল গাঢ় নীল রঙে, যা পূর্ণিমা রাতের আকাশের গভীর নীলিমার কথা মনে করিয়ে দেয়। আর সেই নীল ক্যানভাসের উপর যেন রাতের তারার মতো ছড়ানো ছিল সাদা ও হলুদ রঙের নার্সিসাস বা নার্গিস ফুল।

নকশার নেপথ্যে শিল্পী ও ভাবনা:

এই অসাধারণ নকশার পেছনে রয়েছেন মার্কিন চিত্রশিল্পী সাই গ্যাভিন। জনপ্রিয় ফ্যাশন ম্যাগাজিন ভোগ-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গ্যাভিন জানান, নিউইয়র্কের আপস্টেটে তার স্টুডিওর বাইরে ফুটে থাকা বহুবর্ষজীবী নার্সিসাস ফুল তাকে মুগ্ধ করেছিল। এই ফুলগুলো যেভাবে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে প্রস্ফুটিত হয়, সেই প্রক্রিয়া তাকে আকৃষ্ট করে।

এছাড়াও, ড্যাফোডিল বা নার্সিসাস ফুলকে অনেকেই নতুন ঋতু বা বসন্তের আগমনী বার্তা বাহক হিসেবে দেখেন। অন্যদিকে, মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামের কস্টিউম ইনস্টিটিউটের ফান্ডরাইজিং প্রোগ্রাম, অর্থাৎ মেট গালা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর মে মাসের প্রথম সপ্তাহে। শিল্পী সাই গ্যাভিন এই দুটি ঘটনার মধ্যে একটি যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন। একটি নতুন ঋতু এবং নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে নার্সিসাস ফুলকে বেছে নেওয়ার ভাবনাটি এখান থেকেই এসেছে।

নার্সিসাসের পুরাণ ও শিল্পীর ব্যাখ্যা:

ড্যাফোডিল ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম ‘নার্সিসাস’, যা এসেছে গ্রিক পুরাণের সেই বিখ্যাত এবং বিয়োগান্তক চরিত্র নার্সিসাসের নাম থেকে। পুরাণে বর্ণিত আছে, নার্সিসাস নিজের সৌন্দর্যে এতটাই মুগ্ধ ছিলেন যে নিজের প্রতিবিম্বের প্রেমে পড়েই শেষ পর্যন্ত তার মৃত্যু হয়। তবে শিল্পী সাই গ্যাভিন এই পুরাণের একটি বিশেষ ব্যাখ্যাকে তার নকশার ভিত্তি হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

গ্যাভিনের মতে, যখন নার্সিসাস প্রথমবার জলের মধ্যে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, সেই মুহূর্তের উপলব্ধি ছিল – “নিজের কাছে নিজের স্বীকৃতি এবং কদর পাওয়ার মুহূর্তটাই আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয়।” শিল্পীর কাছে এই ভাবনাটি গভীর অর্থবহ। কারণ, মেট গালার সময় মেট্রোপলিটন মিউজিয়ামে ‘সুপার ফাইন: টেইলরিং ব্ল্যাক স্টাইল’ নামে একটি প্রদর্শনী চলছিল, যা কৃষ্ণাঙ্গদের ফ্যাশন এবং তাদের আত্মপরিচয়কে তুলে ধরেছিল। একজন ব্যক্তির আত্মপরিচয় কিভাবে অন্যরা দেখে এবং বিচার করে, সেই বিষয়টি সেখানে আলোকপাত করা হয়েছিল।

মেট গালার নীলগালিচায় হলিউড অভিনেত্রী কিম কার্ডাশিয়ান

 

গ্যাভিন এই প্রসঙ্গে বলেন, “আশপাশের মানুষেরা আমাদের বিভিন্ন ভাবে দেখে এবং তাদের মতো করেই আমাদের একটি সত্তা তৈরি করে। অন্যের মুখে এসব বিশেষণ বা সংজ্ঞা শোনার পর নিজের সত্যিকারের রূপকে চিনতে না পারাটা খুবই সহজ। এই তীব্র ভাবনা আমার কাছে একপ্রকার শাস্তির মতোই মনে হয়।” নার্সিসাসের আত্ম-উপলব্ধি এবং এই সামাজিক বাস্তবতার মধ্যে একটি সংযোগ খুঁজে পেয়েছেন তিনি।

চিত্রকর্ম থেকে কার্পেট:

এই সমস্ত কল্পনা, অনুভূতি এবং ভাবনাকে একত্রিত করে শিল্পী সাই গ্যাভিন ‘আনটাইটেল্ড (স্কাই)’ নামের একটি চিত্রকর্ম আঁকেন। এই ছবিতে তিনি নার্সিসাস ফুলকে রাতের আকাশের তারারূপে উপস্থাপন করেন। সেট ডিজাইনার ডেরেক ম্যাকলেন এবং ইভেন্ট প্ল্যানার রাউল আভিলা শিল্পীর এই বিশেষ মোটিফটি ব্যবহার করে মেট্রোপলিটন মিউজিয়াম অব আর্টের সুবিশাল সিঁড়ির জন্য অনন্য নীল কার্পেটটি তৈরি করেছেন।

মেট গালা শেষ হওয়ার পর এই কার্পেটটি সরিয়ে নেওয়া হবে, এর স্থায়িত্ব সীমিত। তবে বিশ্বের খ্যাতিমান আলোকচিত্রীদের ক্যামেরায় এটি অমরত্ব লাভ করেছে। কেবল একটি নকশা হিসেবে নয়, এই নীল কার্পেট এবং তার উপর ফুটে থাকা নার্গিস ফুল শিল্পী সাই গ্যাভিনের গভীর ভাবনা, আত্ম-উপলব্ধি এবং আত্মপরিচয়ের এক প্রতীকী প্রকাশ হিসেবে ফ্যাশন ও শিল্প জগতে দীর্ঘকাল আলোচিত হবে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy