মাল্টিপ্লেক্স-এর দাপটে মুছে গেছে ‘ছবিঘর’, ব্যবসা হারিয়ে ধুঁকছে একাধিক সিনেমা হল

একটা সময় ছিল, যখন সিনেমা হলগুলো শুধু বিনোদনের কেন্দ্র ছিল না, ছিল সামাজিক মিলনের এক প্রাণবন্ত ক্ষেত্র। শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, ইসলামপুর বা মালদা—উত্তরবঙ্গের জেলা শহরের মানুষের জীবনে এই সিনেমা হলগুলো অমর টকিজ়, আনন্দলোক, মেঘদূত, বিশ্বদীপ, মেনকা, মায়া টকিজ়, লক্ষ্মী, কমলা, বাস-স্টপের মতো হরেক নামে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছিল। সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ, তা সে উচ্চবিত্তই হোক বা নিম্নবিত্ত, শিক্ষিতই হোক বা নিরক্ষর—সবাইকে একই ছাদের নীচে এক সুতোয় বেঁধে রাখত এই ম্যাজিক বাক্স।

উত্তরবঙ্গের জেলা শহরের মানুষ তো বটেই, বিভিন্ন চা-বাগান থেকেও শ্রমিকরা মাসে অন্তত একবার বাগানের গাড়িতে চেপে আসতেন প্রিয় তারকার মুখ দেখতে। হলের ভেতরের ছবিটাও ছিল সময়ের সঙ্গে বদলানো এক ক্যানভাস। প্রথমে ছিল কাঠের চেয়ার। ষাটের দশকে ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাসের জন্য এলো গদি লাগানো চেয়ারের আরাম। দোতলার আসনগুলো ছিল নারীদের জন্য সংরক্ষিত, যা পরে অবশ্য সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

টিকিটের দামও ছিল নাগালের মধ্যে। ষাটের দশকে ৯০ পয়সা দিয়ে দেখা যেত সিনেমা, আর ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য কনসেশন টিকিট মিলত ৩৭ পয়সায়। সময়ের সঙ্গে টিকিটের দাম বাড়লেও, বর্তমানের মাল্টিপ্লেক্স বা মুভি থিয়েটারের মতো আকাশছোঁয়া দাম কখনো ছিল না।

মাইক, ব্যান্ড আর হেমন্তের সুর:
নতুন কোনো সিনেমা মুক্তির আগে প্রচারের পদ্ধতি ছিল একেবারে অভিনব ও আকর্ষণীয়। আলিপুরদুয়ারের অমর টকিজ়-এর কর্মী শিবুদা মাইক বেঁধে রিকশায় চড়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেন, সামনে থাকত ব্যান্ড পার্টি। তাঁর গমগমে গলায় সিনেমার নাম ঘোষণা আর ব্যান্ডের বাজনা মিলেমিশে এক অদ্ভুত মাদকতা তৈরি করত। সিনেমা শুরু হলে তিনিই আবার টর্চ জ্বালিয়ে টিকিট পরীক্ষা করে দর্শকদের সঠিক আসনে বসিয়ে দিতেন।

তবে অমর টকিজ়-এর আরও এক আকর্ষণ ছিল হলের প্রবেশ পথের দিকে দোতলার একটি জানালায় লাগানো চোঙ। কর্মী বিমল রায় দর্শক টানার জন্য সিনেমা শুরুর আগে সেই চোঙ দিয়ে খালি গলায় অসাধারণ সব গান শোনাতেন, যার বেশিরভাগই ছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান। তাঁর গান এতটাই জীবন্ত ছিল যে, দর্শকরা প্রায়ই বলতেন, ‘আরে! এ তো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলা!’ বিমলবাবু ছুটি নিলে অবশ্য চোঙে ‘কলের গান’ বাজানো হতো।

আলিপুরদুয়ারের নিউটাউন এলাকার মানুষ ছিলেন প্রকৃত সঙ্গীতপ্রেমী। সিনেমার গানগুলো এতটাই তাদের মন ছুঁয়ে যেত যে, অনেকে গেটম্যানকে বলে কিছুক্ষণের জন্য হলের ভিতরে ঢুকে যেতেন। সিনেমার গানগুলো লিখে নিয়ে, যতটা সম্ভব গলায় তুলে নিয়ে তবেই তারা বেরিয়ে আসতেন।

পিন্টু ও রূপশ্রীর উন্মাদনা:
জলপাইগুড়ির সিনেমা হলের ইতিহাসে দীপ্তি টকিজ়-এর কর্মী পিন্টুর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। শুক্রবার নতুন সিনেমা এলে সকাল-সকাল রিকশায় মাইক বেঁধে তার প্রচারের ভঙ্গী ছিল এতটাই আকর্ষণীয় যে, অনেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনতেন। সুপারহিট ছবি এলে তার হাতে শোভা পেত গোছা গোছা লাল, হলুদ বা নীল রঙের পাতলা কাগজে রেভিনিউ স্ট্যাম্প লাগানো টিকিট। এক টাকা ৭০ পয়সার টিকিট দিব্যি পাঁচ টাকায় বিক্রি করে দিতেন পিন্টু—আর তাতে কারো বিন্দুমাত্র অভিযোগ ছিল না। জলপাইগুড়ির কুলীন সিনেমা হল ছিল রূপশ্রী। অনেক শুক্রবারই সেখানে টিকিট কাটার জন্য পুরুষ আর মহিলাদের লাইন কাউন্টার থেকে চলে আসত রাস্তায়। উন্মাদনা ছিল তুঙ্গে।

আবেগ, উচ্ছ্বাস আর হারানো দিন:
পর্দায় যখন রাজেশ খান্না, অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী বা ধর্মেন্দ্র আসতেন, সেকেন্ড আর থার্ড ক্লাসে বসা দর্শকরা মহা উল্লাসে “গুরু, গুরু” বলে চিৎকার করে উঠতেন। হেলেন-এর নাচ শুরু হলে ঘনঘন সিটি বাজত। বিরতির পরে হলজুড়ে অনেকক্ষণ ধরে শোনা যেত বাদামের খোসা ভাঙার মচমচ শব্দ।

বর্তমান সময়ের মাপা হাসি আর চাপা কান্নার মাল্টিপ্লেক্স এই আবেগ, এই উচ্ছ্বাস, এই উন্মাদনা কখনও দেখেনি। কালের নিয়মে সে শুধু মুছে দিয়েছে শিলিগুড়ির উর্বশী, আনন্দলোক, আলিপুরদুয়ারের মেনকা, বাস-স্টপ, কোচবিহারের কমলা, অরুণা, ইসলামপুরের স্টার, রায়গঞ্জের আশা টকিজ়, মালদার লক্ষ্মীর মতো অসংখ্য ছবিঘরকে। এই সিনেমা হলগুলো শুধু ইট-কাঠের কাঠামো ছিল না, ছিল হাজারো স্মৃতির আকর, যেখানে মানুষের হাসি-কান্না, স্বপ্ন আর আবেগ একাকার হয়ে যেত। আজ তারা শুধু স্মৃতির পাতায়।

তথ্যসূত্র: এই সময়

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy