ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে ট্রাম্পের দাবি প্রত্যাখ্যান করলো ভারত

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান যুদ্ধবিরতিতে নিজের অবদানের দাবি পুনরায় সামনে এনেছেন। তবে দিল্লি বৃহস্পতিবার ছয় দফা পৃথক বিবৃতির মাধ্যমে ট্রাম্পের এই দাবিকে স্পষ্টভাবে নাকচ করে দিয়েছে।

পশ্চিম এশিয়া সফরে কাতারে অবস্থিত একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে সেনাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাকালে ট্রাম্প বলেন, “আমি হয়তো সরাসরি বলবো না যে কাজটি আমিই করেছি, তবে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে গত সপ্তাহে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সমস্যা সমাধানে আমি সাহায্য করেছি।” ট্রাম্প দাবি করেন, পরিস্থিতি উত্তপ্ত হচ্ছিল এবং “হঠাৎ করে আপনারা ভিন্ন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র দেখতে শুরু করতেন,” কিন্তু তার হস্তক্ষেপ পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। তিনি আরও বলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা এই যুদ্ধবিরতিকে সম্ভব করেছে। তার ভাষায়, “আমরা তাদের সাথে বাণিজ্য নিয়ে কথা বলেছি। আমি বলেছি, ‘যুদ্ধের বদলে বাণিজ্য করুন।’ পাকিস্তান এতে খুব খুশি ছিল, ভারতও খুব খুশি ছিল। আমি মনে করি তারা এগিয়ে যাচ্ছে।” প্রায় “হাজার বছর ধরে” চলে আসা এই সংঘাত তিনি মিটিয়ে দিয়েছেন বলেও দাবি করেন।

ট্রাম্পের নতুন বক্তব্য

ট্রাম্প নিজেকে ভারত-পাক শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে এটি ছিল তার চতুর্থ প্রচেষ্টা। তার এই দাবিকে সমর্থন জানিয়েছেন মার্কিন উপ-রাষ্ট্রপতি জেডি ভ্যান্সও। ট্রাম্পের সাথে পশ্চিম এশিয়া সফরে থাকা হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লিভিট দোহায় একজন স্থানীয় ব্যক্তির সাথে তার কথোপকথনের উল্লেখ করে এক্স-এ পোস্ট করেন, যেখানে ওই ব্যক্তি বলেছিলেন যে পারমাণবিক যুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যথেষ্ট কৃতিত্ব পাচ্ছেন না। লিভিট লেখেন, “তিনি ঠিক বলেছেন!”

ভারতের কড়া প্রতিক্রিয়া

তবে ট্রাম্পের ‘বাণিজ্যের প্রলোভন’ সংক্রান্ত দাবিকে ভারত শক্তভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। এনডিটিভি সূত্র অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য বৃদ্ধির বিষয়ে এমন কোনো আলোচনা এই যুদ্ধবিরতির সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল না। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ২০৩০ সালের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার একটি বৃহত্তর চুক্তির বিষয়ে আলোচনা করছে, কিন্তু এই চুক্তি এখনও চূড়ান্ত হয়নি এবং এর সাথে ‘অপারেশন সিঁদুর’ বা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধবিরতির কোনো সম্পর্ক নেই। বিদেশ মন্ত্রী এস জয়শঙ্কর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জটিল’ এই চুক্তি নিয়ে আলোচনা চলছে এবং ‘সবকিছু চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত নয়।’

ভারত স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হয়নি এবং কোনো ‘পারমাণবিক উত্তেজনা’ ছিল না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল জানান, ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীন এবং ১০ মে’র যুদ্ধবিরতি পর্যন্ত ভারতীয় ও মার্কিন নেতাদের মধ্যে সামরিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হলেও, বাণিজ্যের বিষয়টি এই প্রসঙ্গে ওঠেনি।

পারমাণবিক সংঘাতের দাবি উড়িয়ে দিল ভারত

ট্রাম্প বারবার ভারত ও পাকিস্তানের হাতে “অনেক অস্ত্র” থাকার কথা উল্লেখ করে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকির কথা বলেছেন এবং তার ‘শান্তি প্রচেষ্টা’র গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ভারত স্পষ্ট করে বলেছে, ‘অপারেশন সিন্দুর’-এর সামরিক পদক্ষেপ সম্পূর্ণরূপে প্রচলিত অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।

ভারত কাশ্মীর ইস্যুতে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাব আগেও প্রত্যাখ্যান করেছে। দিল্লি দীর্ঘকাল ধরেই স্পষ্ট করে আসছে যে কাশ্মীর নিয়ে কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয়। ভারত জোর দিয়ে বলেছে, পাকিস্তানের সাথে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা কেবল তখনই সম্ভব যখন তারা জঙ্গি পরিকাঠামো ধ্বংস করবে এবং অবৈধভাবে দখল করা ভারতীয় ভূখণ্ড ফিরিয়ে দেবে।

বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ

প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক কেপি ফ্যাবিয়ান ট্রাম্পের দাবি নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছেন, “আমেরিকা মধ্যস্থতা করেনি। তারা হয়তো পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করেছে। এটা এমন নয় যে যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বলেছে, ‘আপনারা এটা নিয়ে কথা বলুন’।”

যুদ্ধবিরতির প্রেক্ষাপট

উল্লেখ্য, পাকিস্তানের আকাশসীমায় ক্রমাগত অনুপ্রবেশের জবাবে ভারতের সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর গত ১০ মে এই যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হয়। প্রাথমিকভাবে ১৮ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে এই যুদ্ধবিরতির মেয়াদ।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভারতের স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও ট্রাম্পের বারবার এই ধরনের দাবি এই সংবেদনশীল সময়ে ভারত-মার্কিন কূটনৈতিক সম্পর্কে কিছু জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy