বিহারে পাচার হওয়া তিন হাতিকে ফেরানোর নির্দেশ হাইকোর্টের, ‘রাজ্যের সম্পত্তি’ ভোলা, সুমন, বাসন্তী

পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেআইনিভাবে বিহারে পাচার করা তিনটি হাতি, ভোলা, সুমন এবং বাসন্তীকে বাংলায় ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। মঙ্গলবার বিচারপতি রবিকৃষ্ণ কপূর এবং বিচারপতি অরিন্দম মুখোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, এই তিনটি হাতি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্পত্তি। আদালতের পক্ষ থেকে রাজ্যের বন দফতরের প্রধানকে বিহার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত হাতিগুলিকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

হাতি পাচার রোধে রাজ্যের গা-ছাড়া মনোভাবের সমালোচনা করে আদালত বলেছে, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে হবে। দুই বিচারপতির বেঞ্চের মন্তব্য, “জীবজন্তুর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য।”

কেপ ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা হাতি পাচার নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেছিল। তাদের অভিযোগ, অর্থের বিনিময়ে মোট ২৪টি হাতি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বেআইনিভাবে অন্য রাজ্যে পাচার করা হয়েছে। এর মধ্যে ভোলা, সুমন এবং বাসন্তী নামে তিনটি হাতিকে নির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা গেছে।

জানা গেছে, ভোলা, সুমন এবং বাসন্তী নামের এই তিনটি হাতি আগে ‘নটরাজ সার্কাস’-এর অধীনে ছিল। ২০১৭ সালে একটি ‘উপহারপত্রের’ মাধ্যমে সার্কাস কর্তৃপক্ষ এই হাতিগুলিকে বিহারের গোপালগঞ্জ জেলার একটি আশ্রমে পাঠিয়ে দেয়। বর্তমানে গোপালগঞ্জের আশ্রমের মহন্ত সত্যদেব দাস দাবি করছেন যে, তিনিই এখন এই হাতিগুলির মালিক।

এখানে প্রশ্ন উঠেছে, ২০১৩ সালে নটরাজ সার্কাসের মালিকানার শংসাপত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও ২০১৭ সালে তারা কীভাবে এই হাতিগুলিকে আশ্রমে পাঠাল? মামলাকারী কেপ ফাউন্ডেশনের বক্তব্য, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে হাতি পাঠাতে গেলে রাজ্যের বন দফতরের অনুমতি নিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সেই অনুমতি নেওয়া হয়নি, যা বেআইনি।

সমস্ত সওয়াল-জবাব শেষে হাইকোর্ট বিহার সরকারের সঙ্গে কথা বলে হাতিগুলিকে দ্রুত রাজ্যে ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে, ভবিষ্যতে হাতি পাচার রুখতে রাজ্যের সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর জন্য দুই বিচারপতির বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে।

কলকাতা হাইকোর্টের এই নির্দেশ বেআইনি হাতি পাচার রোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এটি বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় আদালতের অঙ্গীকার এবং রাজ্য সরকারকে এই বিষয়ে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবে।

বিশ্লেষণমূলক সংবাদ প্রতিবেদন
হাতি পাচার: কলকাতা হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়, ‘রাজ্যের সম্পত্তি’ ও বন্যপ্রাণ সুরক্ষা নিয়ে কড়া বার্তা

কলকাতা হাইকোর্টের একটি সাম্প্রতিক রায় বন্যপ্রাণী পাচার রোধে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিহারে বেআইনিভাবে পাচার হওয়া তিনটি হাতি, ভোলা, সুমন এবং বাসন্তীকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশের পাশাপাশি আদালত রাজ্যের বন দফতরকে গা-ছাড়া মনোভাব ত্যাগ করার কড়া বার্তা দিয়েছে। এটি কেবল তিনটি হাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়, বরং বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইন, আন্তঃরাজ্য সমন্বয় এবং জীবজন্তুর প্রতি সামাজিক দায়িত্ববোধ নিয়ে এক গভীর বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

আদালতের এই মন্তব্য যে, “ভোলা, সুমন আর বাসন্তী পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সম্পত্তি,” অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এর মাধ্যমে আদালত স্পষ্ট করেছে যে, বন্যপ্রাণীরা কেবল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানার বিষয় নয়, বরং তারা রাষ্ট্রের এবং বৃহত্তরভাবে সমগ্র পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই রায় বেআইনি পাচারকারীদের মালিকানার দাবিকে চ্যালেঞ্জ করে, বন্যপ্রাণীর আইনগত অধিকারকে সুদৃঢ় করে।

২০১৩ সালে নটরাজ সার্কাসের মালিকানার শংসাপত্রের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরেও ২০১৭ সালে ‘উপহারপত্র’-এর মাধ্যমে হাতি পাচারের ঘটনা আইন লঙ্ঘনের এক স্পষ্ট উদাহরণ। বন্যপ্রাণী (সুরক্ষা) আইন অনুযায়ী, এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে বন্যপ্রাণী স্থানান্তরের জন্য নির্দিষ্ট অনুমতি প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সেই অনুমতি না নেওয়ার অভিযোগটি একটি বড় ধরনের আইনগত ত্রুটি। আশ্রমের মহন্তের ‘মালিকানা’র দাবিও আদালতের রায়ের ফলে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

হাইকোর্ট বিহার সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাতিগুলিকে ফেরানোর নির্দেশ দিয়ে আন্তঃরাজ্য সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছে। বন্যপ্রাণী পাচার একটি আন্তঃরাজ্য এবং অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ। এই ধরনের অপরাধ দমনে রাজ্যগুলির মধ্যে নিবিড় সমন্বয় অপরিহার্য। একইসঙ্গে, ভবিষ্যতে হাতি পাচার রুখতে সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ প্রমাণ করে যে, আদালত এই সমস্যার মূলে গিয়ে তার সমাধান চাইছে। ভারতের মতো বিশাল দেশে যেখানে বন্যপ্রাণী পাচার একটি বড় সমস্যা, সেখানে সীমান্ত নজরদারি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দুই বিচারপতির বেঞ্চের মন্তব্য, “জীবজন্তুর প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য,” এই রায়কে কেবল আইনগত নির্দেশিকায় সীমাবদ্ধ রাখেনি, বরং এটিকে একটি সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ববোধের উচ্চতায় উন্নীত করেছে। এটি মানুষের প্রতি প্রকৃতির অংশ হিসেবে বন্যপ্রাণীদের প্রতি সংবেদনশীল হতে এবং তাদের অধিকারকে সম্মান জানাতে উৎসাহিত করে।

কলকাতা হাইকোর্টের ভোলা, সুমন এবং বাসন্তীকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ বন্যপ্রাণী সুরক্ষা আইনে এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এটি রাজ্য সরকারকে বন্যপ্রাণী পাচার রোধে আরও কঠোর এবং সক্রিয় ভূমিকা পালনে বাধ্য করবে। এই রায় শুধু তিনটি হাতির জীবন রক্ষা করবে না, বরং বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ দমনে একটি শক্তিশালী বার্তা দেবে। বন্যপ্রাণী পাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্য আইনি পদক্ষেপ, আন্তঃরাজ্য সহযোগিতা এবং সামাজিক সংবেদনশীলতা – এই তিনটিই অপরিহার্য।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy