
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে ইরানের তিনটি সামরিক ঘাঁটিতে মার্কিন বিমান বাহিনীর অভূতপূর্ব হামলা মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাকে আরও গভীর করেছে। ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর এই প্রথম কোনো পশ্চিমা দেশ ইরানের মাটিতে সরাসরি হামলা চালাল, যা পরিস্থিতিকে এক নতুন সংকটের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন প্রশ্ন, ইরান কীভাবে এর জবাব দেবে? আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিয়ে এই মার্কিন হামলার জবাব দিতে পারে ইরান।
হরমুজ প্রণালী: কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
হরমুজ প্রণালী, যার দৈর্ঘ্য ৩৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ৩ থেকে ৩৯ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত, একদিকে ইরান এবং অন্যদিকে ওমান দ্বারা বেষ্টিত। এই জলপথ পারস্য উপসাগরকে আরব সাগর ও ওমান উপসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে এবং ইরানকে আরব উপদ্বীপ থেকে পৃথক করেছে।
এটি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক পথ। প্রতিদিন এই প্রণালী দিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রায় ২ কোটি ব্যারেল তেল এবং সমপরিমাণ তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) বিভিন্ন বন্দরে পৌঁছায়। বৈশ্বিক জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মোট সরবরাহের এক পঞ্চমাংশ এই হরমুজ প্রণালী দিয়েই পরিবাহিত হয়। জ্বালানি তেল ও বিপণনকারী সংস্থা ভোরটেক্সা’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে এই জলপথ দিয়ে দৈনিক ১ কোটি ৭৮ লাখ থেকে ২ কোটি ৮ লাখ ব্যারেল পরিশোধিত-অপরিশোধিত জ্বালানি তেল এবং LNG পরিবহন করা হয়েছে।
তেল উত্তোলন ও বিপণনকারী দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের সদস্য রাষ্ট্র সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত এবং ইরাক তাদের বেশিরভাগ তেল হরমুজ প্রণালী দিয়ে এশিয়ার দেশগুলোতে পাঠায়। এই পথে চলাচলকারী বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর ৫ম নৌবহর।
হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে কী হবে?
যদি ইরান হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়, তবে এর বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব পড়বে। বিশ্বজুড়ে দৈনিক তেল সরবরাহের এক পঞ্চমাংশ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম হু হু করে বাড়বে, যা বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এক বড় ধাক্কা দেবে।
তবে, এমন পদক্ষেপ ইরানের জন্য ‘আত্মঘাতী’ হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। কারণ জ্বালানি তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ইরানের তেলও এই জলপথ দিয়েই বিশ্বে যায়। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো বর্তমানে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে ইরানের পক্ষে থাকলেও, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে নিজেদের স্বার্থেই তারা সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে পারে। শুধু তাই নয়, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে চীনেরও বড় ক্ষতি হবে, কারণ চীন ইরানের তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। ইরানের মোট উৎপাদিত তেলের ৯০ শতাংশই চীনে রফতানি হয়।
ইরানের অবস্থান ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ:
রোববার ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন চ্যানেল প্রেস টিভি জানিয়েছে, ইরানের পার্লামেন্ট মজলিশে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেওয়া বিষয়ক একটি বিল পাস হয়েছে। তবে এ ইস্যুতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিই দেবেন।
ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৈয়দ আব্বাস আরাগচি রোববার জানিয়েছেন, ইরানে মার্কিন বাহিনীর বোমাবর্ষণের জন্য ‘গুরুতর পরিণতি’ ভোগ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মার্কো রুবিও জানিয়েছেন যে, ওয়াশিংটন হরমুজ প্রণালী বন্ধ করা থেকে ইরানকে বিরত রাখতে চীনের সহযোগিতা চেয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজকে সোমবার তিনি বলেছেন, “যদি তারা সত্যিই হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়— তাহলে তা হবে একটি ভয়াবহ ভুল পদক্ষেপ এবং একই সঙ্গে তাদের নিজেদের জন্য অর্থনৈতিক আত্মহত্যা। কারণ এই প্রণালী দিয়ে তাদের তেলও পরিবহন করা হয়।” তিনি বেইজিংকে এ ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে কথা বলার আহ্বান জানিয়েছেন, কারণ চীন ইরানের তেলের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল।
পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল, এবং বিশ্বজুড়ে নজর রাখা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে।