বিশেষ: মাছিও প্রবেশ করতে পারত না যেখানে, সেখান থেকেই চুরি হয় ১০ কোটি ডলারের হীরা!

একটা মাছিও নাকি প্রবেশ করতে পারত না, এমনই ছিল সিন্দুকের নিরাপত্তা। শুধু সিন্দুকে নয়, সেই সিন্দুক যে বহুতলে রাখা ছিল, তার আশপাশের রাস্তাতেও ছিল কড়া নজরদারি। দিন-রাত সেখানে ঘোরাফেরা করতেন সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষীরা। বিশেষ নজরদারির জন্য আস্ত একটা থানাই বসানো ছিল সেখানে। সেই নিরাপত্তা ভেদ করে ১০ কোটি ডলারের হীরা চুরি হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে যার মূল্য প্রায় ১১’শ কোটি টাকা। ‘আন্তওয়ার্প ডায়মন্ড হাইস্ট’ নিয়ে আজও রয়েছে গিয়েছে নানা প্রশ্ন।
২০০৩ সালে বেলজিয়ামের আন্তওয়ার্পে হয়েছিল সেই হীরা চুরি। কারা চুরি করেছিল, কী ভাবে হয়েছিল চুরি, সেই নিয়ে আজও রয়ে গিয়েছে ধন্দ। চুরির অভিযোগে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কিন্তু চুরিতে তার কতটা ভূমিকা ছিল, তিনিই মূল চক্রী কি না, তা এখনও জানা যায়নি।

আন্তওয়ার্পের ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্টের সব থেকে বড় বহুতল ডায়মন্ড সেন্টার। সেখানে সারা দুনিয়ার হীরা কেনাবেচা চলে। শতাধিক হীরা ব্যবসায়ীর দফতর রয়েছে সেখানে। ডায়মন্ড সেন্টারের মাটির নীচে দুটো তলায় রাখা ছিল সিন্দুক। সেই সিন্দুকে নিজেদের সঞ্চয় ভরে রাখতেন ব্যবসায়ীরা।

সুরক্ষিত সেই সিন্দুকের ভিতর থেকে হীরার প্রায় ১০০টি বাক্স চুরি গিয়েছিল। বাকি বাক্স চেষ্টা করেও নিয়ে যেতে পারেনি চোরেরা। আন্তওয়ার্প পুলিশের আধিকারিক প্যাট্রিক পে জানিয়েছেন, এত সুরক্ষিত একটি বহুতল থেকে যে এ ভাবে হীরা চুরি যেতে পারে, তা বিশ্বাস করা কঠিন।

ডায়মন্ড সেন্টারের সামনের রাস্তায় ২৪ ঘণ্টা পাহারা দিতেন নিরাপত্তারক্ষীরা। সেখানে বসানো থাকত অসংখ্য ক্যামেরা। তাতে ধরা পড়ত পথচারীদের গতিবিধি। সেই রাস্তায় গাড়ি চলাচলেও নিষেধাজ্ঞা ছিল।

ওই বিল্ডিংয়ে যারা প্রবেশ বা প্রস্থান করতেন, তাদের ছবি তোলা হত। তা হলে চুরি করলেন কে? কী ভাবে? পুলিশের সন্দেহ, ওই ডায়মন্ড সেন্টারের এক ভাড়াটে ব্যবসায়ীই চুরি করেছিলেন।

অভিযুক্ত ছিলেন ইতালির তুরিনের এক জন ছোটখাটো হীরা ব্যবসায়ী। নাম লিয়োনার্দো নোতারবার্তোলো। স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে আন্তওয়ার্পের উপকণ্ঠে বাস করতেন তিনি।

স্থানীয়দের দাবি, লিয়োনার্দো ঝুটঝামেলায় জড়াতেন না। ঘোরতর সংসারী ছিলেন। অবসরে ফুটবল খেলতেন।

যদিও তুরিন পুলিশের খাতায় বেশ কয়েক বার নাম উঠেছিল লিয়োনার্দোর। ছোটখাটো চুরি, ছিনতাইয়ের অভিযোগ উঠেছিল। তবে আন্তওয়ার্পের ডায়মন্ড সেন্টারে চুরির আগে ২০ বছর কোনও অপরাধে নাম জড়ায়নি লিয়োনার্দোর।

পুলিশের অনুমান, আসলে বড় ছক কষছিলেন তিনি। গোপনে অপরাধীদের একটি দলে যোগ দিয়েছিলেন। আবার এমনও হতে পারে, পরিকল্পনা করে বেশ কয়েক জন অপরাধীকে জুটিয়ে এই কাজ করেছিলেন তিনি।

তদন্তে জানা গিয়েছিল, চুরির আগে মাসে এক বার করে ডায়মন্ড সেন্টারে যেতেন লিয়োনার্দো। তবে চুরির ঠিক আগের সপ্তাহে প্রায় রোজ যেতেন তিনি। একই দিনে দু-তিন বারও গিয়েছেন বলে ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল।

পুলিশের ধারণা, গোটা এলাকা রেইকি করার জন্য যেতেন তিনি। আশপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা খতিয়ে দেখতেন।

ঠিক কী ভাবে ঘটেছিল ওই চুরি? পুলিশ জানিয়েছে, ২০০৩ সালের ১৫ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে চুরি হয়েছিল। শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ডায়মন্ড সেন্টারের দরজা। ওই রাতে লিয়োনার্দোকে শেষ বার সিন্দুকের সামনে ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছিল।

পরের দিন, শনিবার রাতে লিফ্‌টে চেপে সিন্দুক যেখানে রাখা ছিল, সেখানে নেমেছিলেন দু-তিন জন। তারা শুক্রবার ডায়মন্ড সেন্টার বন্ধ হওয়ার আগেই সম্ভবত ঢুকে বসেছিলেন। তবে কী ভাবে, তা নিয়ে আজও ধোঁয়াশা রয়েছে।

যেখানে সিন্দুক ছিল, সেখানে কারও গতিবিধি ধরার জন্য মোশন ডিটেক্টর যন্ত্র বসানো ছিল। সেই যন্ত্রের উপর সিলিকন স্প্রে করেছিলেন অভিযুক্তের। ফলে তাদের গতিবিধি ধরতে পারেনি ওই যন্ত্র।

সিন্দুক যেখানে রাখা ছিল, সেখানে একটি লাইট ডিটেক্টরও ছিল। ওই চত্বর দিয়ে কেউ হেঁটে গেলে লাইট ডিটেক্টরে ধরা পড়ত। সেই যন্ত্রের উপর কালো টেপ জড়িয়ে রেখেছিলেন অভিযুক্তেরা। ফলে তারা ইচ্ছামতো হাঁটাচলার পরেও ধরা পড়েনি লাইট ডিটেক্টরে।

সিন্দুকের পাশেই ছিল একটি ঘর। সেই ঘরের মধ্যে একটি ধাতব বাক্সে রাখা ছিল সিন্দুকের চাবি। সেই ঘরে ঢুকে বাক্স ভেঙে চাবি বার করা হয়েছিল। তবে শুধু চাবি নয়, সিন্দুক খোলার জন্য গুপ্ত সঙ্কেত (পাসওয়ার্ড)-এর প্রয়োজন হয়। সেই পাসওয়ার্ডের হদিস কী ভাবে পেলেন অভিযুক্তেরা, তা নিয়েও রয়েছে ধোঁয়াশা।

সিন্দুকের দরজা ছিল ২ ফুট চওড়া। শক্ত ধাতুর তৈরি। সেই দরজায় বসানো ছিল চুম্বক। দরজা খুললেই চুম্বক দু’টি পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। আর তখনই বাজতে শুরু করত অ্যালার্ম। তাতে সতর্ক হয়ে যেতেন থানার পুলিশ কর্মকর্তারা।

কিন্তু চুরির দিন এ রকম কিছুই ঘটেনি। সিন্দুকের দু’টি দরজা যেখানে মিলিত হয়, সেই অংশে বসানো ছিল চুম্বক। সেই চুম্বক বসানো অংশটি অক্ষত রেখে বাকি অংশ কেটে নেন অভিযুক্তেরা। ফলে চুম্বক দু’টি পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি। সে কারণে অ্যালার্মও বাজেনি।

ওই কাটা অংশ দিয়ে সিন্দুকের ভিতর ঢুকে পড়েন অভিযুক্তেরা।

পুলিশের অনুমান, পরবর্তী চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলেছিল লুট। অভিযুক্তেরা শুধু হীরা চুরি করেছিলেন। হীরার ঘড়ি, গয়না নেওয়ার চেষ্টা করেননি। কারণ এত কিছু একসঙ্গে তারা নিতে পারবেন না বলেই ফেলে রেখে গিয়েছিলেন।

পুলিশ তদন্তে জানতে পারে, ডায়মন্ড সেন্টারের সব ঘর এবং দরজার ভুয়ো চাবি বাড়িতে বসে তৈরি করেছিলেন অভিযুক্তেরা। এমনকি বহুতলের নীচে গ্যারেজের চাবিও তৈরি করেছিলেন তারা। সেই গ্যারেজের একটি দরজা দিয়ে বার হলে ডায়মন্ড ডিস্ট্রিক্টের বাইরের রাস্তায় পৌঁছে যাওয়া যেত। সে ক্ষেত্রে থানার সামনে দিয়ে যেতে হত না। পুলিশি ব্যারিকেডের মুখে পড়তে হত না।

ওই ডায়মন্ড সেন্টারে কাজ করার জন্য সেই দরজার কথা জানতেন লিয়োনার্দো বলে মনে করে পুলিশ। চুরির পর সেই দরজা দিয়েই পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি এবং তার সঙ্গীরা।

পুলিশের অনুমান, চুরির পর লিওনার্দোর আন্তওয়ার্পের বাড়িতে গিয়েছিল চোরেরা। এর পর রাতের অন্ধকারে সেখান থেকে শহর ছাড়েন। শহর থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দূরে একটি জঙ্গলে গিয়ে জড়ো হন অভিযুক্তেরা। সেখানেই ফেলে আসেন একটি ব্যাগ। আর গোটা অধ্যায়ের প্রথম ভুলটা করে ফেলেন।

সেই ব্যাগে ছিল একটি দস্তানা, হীরা রাখার খাম, কিছু নথি আর টাকা। জঙ্গল সাফ করতে এসে ব্যাগটা দেখেন এক ব্যক্তি। খবর দেন পুলিশকে। পুলিশ এসে দেখে ওই ব্যাগের মধ্যে রয়েছে আরও একটি ছোট ব্যাগ। যার মধ্যে ছিল একটি মুদি দোকানের বিল। সেই বিল দেখেই লিয়োনার্দোর সঙ্গে যোগ খুঁজে বার করে পুলিশ।

এর পরেই ডায়মন্ড সেন্টারের সিন্দুকে গিয়ে লিয়োনার্দোর নিজস্ব হীরার বাক্সে তল্লাশি চালায় পুলিশ। দেখা যায়, সেটি অক্ষত রয়েছে। এর পর লিওনার্দোর বাড়িতে গিয়ে ১৭টি হীরা খুঁজে পায় পুলিশ, যার শংসাপত্র রাখা ছিল ডায়মন্ড সেন্টারের সিন্দুকে। অর্থাৎ সেগুলির মালিক যে লিয়োনার্দো, তা প্রমাণিত হয়।

চুরির এক সপ্তাহ পর ডায়মন্ড সেন্টারে নিজের দফতরে যান লিয়োনার্দো। এমন ভান করেন, যেন কিছুই হয়নি। তখনই তাকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। যদিও চুরির বিষয়ে তিনি কোনও কথা স্বীকার করেছেন কি না, জানায়নি পুলিশ।

মনে করা হয়, পুলিশ তাকে দিয়ে কোনও কথাই স্বীকার করাতে পারেননি। বছরের পর বছর চলছে তদন্ত, বিচার। এখনও হীরার হদিস মেলেনি। কোথায় গেল সেই কোটি কোটি টাকার হীরা? কে কিনল? কে বিক্রি করল? কোনও রহস্যেরই সমাধান হয়নি।

সূত্র: ওয়্যার্ড, আনন্দবাজার

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy