
সম্প্রতি ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত ও কাশ্মীরে ঘটে যাওয়া সংঘাতের ঘটনায় তুরস্ক ও আজারবাইজানের পাকিস্তানপন্থী অবস্থান ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। “কোন মুখে পাকিস্তানকে সমর্থন?” – এই প্রশ্ন এখন মুখে মুখে ঘুরছে, এবং এর প্রতিক্রিয়ায় ওই দুই দেশ বয়কটের ডাক উঠেছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও আজারবাইজান ভ্রমণের পরিকল্পনা বাতিল করছেন বহু ভারতীয়।
প্রসঙ্গত, ২২ এপ্রিল জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে জঙ্গিরা ২৬ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এই হামলার জন্য সরাসরি পাকিস্তানকে দায়ী করে নয়াদিল্লি। এর পাল্টা হিসেবে ৭ মে ভারতীয় সেনা ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে পাকিস্তানের ৯টি জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেয়।
এই ঘটনার পরই পাকিস্তানের সমর্থনে বিবৃতি দেয় তুরস্ক ও আজারবাইজান। তাদের মতে, ভারতের এই অভিযানে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন হয়েছে এবং নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা ভারতের এই অভিযানকে ‘উস্কানিমূলক আগ্রাসন’ বলে নিন্দাও জানায়। যৌথ বিবৃতিতে তারা বলে, ‘পাকিস্তানের পাশে আছি। দুই দেশকে কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানাই।’ এই বিবৃতির পরই ভারতীয়দের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং বয়কটের ডাক ওঠে।
সাধারণ ভারতীয়রা সামাজিক মাধ্যম সহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তাদের ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। তুরস্ক ও আজারবাইজানের এমন অবস্থানে হতবাক অনেকেই। বিশেষ করে ওই দুই দেশে বেড়াতে যেতে ইচ্ছুক অনেকেই তাদের পরিকল্পনা বাতিল করছেন।
শুধু সাধারণ মানুষ নয়, বড় ট্রাভেল এজেন্সিগুলিও এই বয়কট ক্যাম্পেনে যোগ দিয়েছে। ইজ মাই ট্রিপ-এর মতো নামকরা ট্র্যাভেল এজেন্সি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, তুরস্ক ও আজারবাইজান যে ভাবে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাতে খুব জরুরি কাজ না থাকলে ওই দুই দেশে না যাওয়াই ভালো। এছাড়াও ইক্সিগো তুরস্ক, আজারবাইজান ও চিনের বিমান ও হোটেল বুকিং আপাতত বন্ধ রেখেছে। কক্স অ্যান্ড কিংস জানিয়েছে, তারা আজারবাইজান, উজবেকিস্তান ও তুরস্ক বেড়ানোর কোনও নতুন অফার দেবে না।
এর প্রত্যক্ষ প্রভাবে ওই দুই দেশের পর্যটনে বড়সড় ধাক্কা লাগার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার ভারতীয় তুরস্কে এবং ২ লক্ষ ৪০ হাজার জন আজারবাইজানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। ইজ মাই ট্রিপ -এর নিশান্ত পিট্টির মতে, প্রত্যেক ভারতীয় পর্যটক তুরস্কে গড়ে প্রায় ১,২০০ থেকে ১,৫০০ ডলার খরচ করেন। ২০২৩ সালে তাঁরা সব মিলিয়ে তুরস্কে প্রায় ৩৫০–৪০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন। রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের পর সব থেকে বেশি আজারবাইজানে পর্যটক যায় ভারত থেকে। গাবালা ও বাকু ভারতীয় পর্যটকদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গন্তব্য। বর্তমানে বুকিং প্ল্যাটফর্মগুলোর তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ওই দুই দেশের জন্য বুকিং কমছে এবং অনেকেই টিকিট বাতিল করছেন।
বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে। ২০২৪–২৫ সালের এপ্রিল থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত, ভারত ৫.২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য তুরস্কে রপ্তানি করেছে (যা আগের বছরের তুলনায় কম)। একই সময়ে তুরস্ক থেকে আমদানি হয়েছে ২.৮৪ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য (আগের বছরের ৩.৭৮ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় আমদানির পরিমাণও কমেছে)। আজারবাইজানে ভারতের রপ্তানি ছিল ৮৬.০৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য (২০২৪–২৫, এপ্রিল-ফেব্রুয়ারি), আগের বছরে এর পরিমাণ ছিল ৮৯.৬৭ মিলিয়ন ডলার। আমদানি ছিল ১.৯৩ মিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের ০.৭৪ মিলিয়ন ডলার থেকে সামান্য বেশি। উভয় দেশের সঙ্গেই ভারতের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে। তবে বয়কট আরও জোরদার হলে তুরস্ক ও আজারবাইজানের রপ্তানিকারকদের জন্য আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কা থাকছে বলে মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহলের একাংশ।
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে তুরস্কের তৈরি Asisguard Songar ড্রোন ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে, যা ভারতীয়দের ক্ষোভ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভারতও পাল্টা পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই, কেন্দ্র তুরস্কেরই সংস্থা ‘সেলেবি অ্যাভিয়েশন’-এর সিকিওরিটি ক্লিয়ারেন্স বাতিল করেছে। ভারতের প্রধান নয়টি বিমানবন্দরে কার্গো ও গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের ব্যবস্থাপনার কাজে যুক্ত ছিল এই সংস্থা। উল্লেখ্য, সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি উঠেছিল যে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এর্দোগানের পরিবারের সদস্য বা তাঁর মেয়ে এই সংস্থা চালান। বৃহস্পতিবার ব্যুরো অফ সিভিল এভিয়েশন সিকিওরিটি বা বিসিএএস ‘সেলেবি এয়ারপোর্ট সার্ভিসেস ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড’-এর নিরাপত্তা ছাড়পত্র বাতিল করে দেয়।
উল্লেখ্য তুরস্কে বর্তমানে প্রায় ৩,০০০ ভারতীয় রয়েছেন, এদের মধ্যে ২০০ জন পড়ুয়া। আজারবাইজানে ভারতীয়ের সংখ্যা ১,৫০০-র সামান্য বেশি।
সব মিলিয়ে, সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক সংঘাতের সরাসরি প্রভাব পড়েছে ভারত ও এই দুই দেশের সম্পর্ক, বিশেষ করে পর্যটন ও বাণিজ্যের উপর। পরিস্থিতি কোন দিকে যায়, এখন সেটাই দেখার।