
পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেনে হামলার ঘটনায় নিহতের সংখ্যা এখনও সরকারিভাবে প্রকাশ করা হয়নি। তবে পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী দাবি করেছে, তারা অভিযান চালিয়ে ৩৩ জন হামলাকারীকে হত্যা করেছে। গত সপ্তাহে কোয়েটা থেকে পেশোয়ারগামী এই ট্রেনটি বোলান উপত্যকার কাছে হামলার শিকার হয়। চার শতাধিক যাত্রীবাহী এই ট্রেনে হামলার দায় স্বীকার করেছে বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ), যারা এটিকে তাদের সাম্প্রতিক বছরগুলোর সবচেয়ে বড় হামলা বলে দাবি করেছে।
হামলা ও পাকিস্তানি সেনার অভিযান
হামলার দুই দিন পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জানায়, তারা একটি বড় অভিযান চালিয়ে যাত্রীদের উদ্ধার করেছে এবং ৩৩ জন হামলাকারীকে নিহত করেছে। বিএলএ দাবি করেছে, তারা বেসামরিক যাত্রীদের মুক্তি দিয়েছিল এবং জিম্মি হিসেবে শুধু পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের রেখেছিল। গোষ্ঠীটি আরও বলেছে, তারা বেলুচিস্তানে আটক রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে এই হামলা চালিয়েছে। তবে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এখনও নিহত যাত্রীদের সংখ্যা বা পরিচয় নিশ্চিত করা হয়নি।
এই ঘটনা দুই দিন ধরে বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে ছিল। হামলার পর পাকিস্তানি সেনা হেলিকপ্টার ও বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করে উদ্ধার অভিযান শুরু করে। বিএলএ-র দাবি, তাদের যোদ্ধারা সেনার আক্রমণ প্রতিহত করেছে, তবে সেনাবাহিনী বলছে, তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এনেছে।
বেলুচ লিবারেশন আর্মি কারা?
বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী, যারা বেলুচিস্তানকে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন করতে চায়। ১৯৭০-এর দশকে এই গোষ্ঠীর উত্থান হয় বলে মনে করা হয়, যখন পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টোর সরকার ক্ষমতায় ছিল। সামরিক শাসক জিয়া-উল-হকের সময় জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বিএলএ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু ২০০০ সালে পারভেজ মোশাররফের শাসনামলে তারা পুনরায় সক্রিয় হয়।
২০০৬ সালে পাকিস্তান বিএলএ-কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং এর নেতা হিসেবে বালাচ মাররিকে চিহ্নিত করে। ২০০৭ সালে ডুরান্ড লাইনের কাছে সংঘর্ষে বালাচ নিহত হন। এরপর তার ভাই হারবিয়ার মাররিকে নেতা হিসেবে ধারণা করা হয়, যিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে থাকেন। তবে হারবিয়ার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। এছাড়া, আসলাম বালোচ নামে আরেক নেতার নামও উল্লেখযোগ্য। কিছু রিপোর্টে বলা হয়, তিনি ভারতে চিকিৎসা নিয়েছিলেন এবং পরে পুনরায় সক্রিয় হন।
বিএলএ-র হামলার ইতিহাস
বিএলএ ২০০০ সাল থেকে পাকিস্তানের সরকারি সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একাধিক হামলা চালিয়েছে। ২০১৭ সালে তারা বেলুচ রাজি অজয় সাঙ্গার (বিআরএএস) নামে একটি জোটে যোগ দেয়, যেখানে বেলুচ লিবারেশন ফ্রন্ট ও বেলুচিস্তান রিপাবলিকান গার্ডও রয়েছে। এই জোট ২০১৮ সালে প্রথম আত্মঘাতী হামলার দায় স্বীকার করে, যখন আসলাম বালোচের ছেলে চীনা প্রকৌশলীদের বহনকারী একটি বাসে হামলা চালায়। একই বছর করাচির চীনা কনস্যুলেটে হামলা এবং ২০১৯ সালে গোয়াদারের পার্ল কন্টিনেন্টাল হোটেলে হামলার দায়ও তারা স্বীকার করে।
২০২২ সালে শারি বালোচ নামে এক নারী সদস্য করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা অধ্যাপকের ওপর হামলা চালান। ২০২৩ ও ২০২৪ সালে সামিয়া কালান্দারানি এবং মাহুল বালোচ নামে দুই নারী পাকিস্তানি ফ্রন্টিয়ার কর্পসের ওপর আত্মঘাতী হামলা চালান। এবার জাফর এক্সপ্রেসে হামলা বিএলএ-র সাম্প্রতিক বছরগুলোর অন্যতম বড় অভিযান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিএলএ?
বেলুচিস্তান পাকিস্তানের বৃহত্তম প্রদেশ এবং খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু বিএলএ-র অভিযোগ, পাকিস্তান সরকার এই সম্পদ শোষণ করছে, যার সুফল স্থানীয় বেলুচ জনগণ পায় না। তারা দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতা এবং নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে আসছে। পাকিস্তান সরকারের দমননীতি, রাজনৈতিক বন্দিদের আটক এবং জোরপূর্বক গুমের অভিযোগ তাদের এই সংগ্রামকে তীব্রতর করেছে।
শেষ কথা
জাফর এক্সপ্রেসে হামলা বেলুচিস্তানে চলমান সংঘাতের একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। পাকিস্তান সরকার এই হামলাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ বলে অভিহিত করলেও, বিএলএ এটিকে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অংশ বলে দাবি করছে। এই ঘটনা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এবং বেলুচিস্তানের সংকট নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
সূত্র: বিবিসি বাংলা