বিশেষ: বিদেশে কীভাবে কাজ করে ইসরায়েলি গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক? জেনেনিন তাদের কার্যপদ্ধতি?

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে টার্গেট করে চালানো অসংখ্য হত্যাকাণ্ডে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর জড়িত থাকার অভিযোগ নতুন নয়। বিশেষ করে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের নিখুঁত ও রহস্যময় অভিযানগুলো প্রায়শই গোয়েন্দা উপন্যাসের কাহিনীকেও হার মানায়। সম্প্রতি ইরানের ওপর ইসরায়েলের প্রথম দিনের হামলায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার নিহত হওয়ার ঘটনা ফের এই প্রশ্ন সামনে এনেছে: ইসরায়েল কীভাবে তার শত্রুদের বিরুদ্ধে এত সফল অভিযান চালাতে পারে? কীভাবে কাজ করে তাদের এই দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক?

টার্গেট কিলিংয়ের দীর্ঘ ইতিহাস

২০২৪ সালের এপ্রিলে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানি কূটনৈতিক ভবনে ইসরায়েলি হামলায় ইরানি বিপ্লবী গার্ডসহ ১৩ জন নিহত হন। একই বছরের জুলাইয়ে হামাসের প্রধান ইসমাইল হানিয়াহ তেহরানে নিহত হন। ইসরায়েল এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার না করলেও এর পেছনে ইসরায়েলের জড়িত থাকার অনুমান প্রবল।

তবে এই ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন নয়। গত বছরের ২৭শে সেপ্টেম্বর লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় হেজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হন। ইসরায়েলি বাহিনী শুধু ব্যক্তিকেই নয়, হেজবুল্লাহর যোগাযোগ ব্যবস্থাকেও লক্ষ্যবস্তু করেছিল। পেজার ও ওয়াকি-টকির বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রায় ৩৭ জনকে হত্যা করা হয়। এমনকি, ২০২৪ সালের প্রথম দিকেই এক সপ্তাহের ব্যবধানে হেজবুল্লাহর কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ইসরায়েলের গুপ্ত হামলায় নিহত হন।

ইসরায়েলের গোয়েন্দা কাঠামোর অন্দরে

ইসরায়েলের এই নিখুঁত ও সফল অভিযানের পেছনে রয়েছে তাদের সুসংগঠিত এবং অত্যাধুনিক গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। তিনটি প্রধান ইউনিট এই কাঠামোর স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে:

১. মোসাদ (Mossad): ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর পর ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করা এই সংস্থাটির মূল কাজ হলো ইসরায়েলকে বাইরের হুমকি থেকে রক্ষা করা এবং দেশটির অস্তিত্ব নিরাপদ রাখা।

২. শাবাক বা শিন বেট (Shabak/Shin Bet): ১৯৪৯ সালে গঠিত এই গোয়েন্দা সংস্থার দায়িত্ব দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তারা পশ্চিম তীর ও গাজা থেকে আসা হুমকি মোকাবিলায় ‘অদৃশ্য ঢাল’ হিসেবে কাজ করার দাবি করে।

৩. আমান (Aman): ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা এটি, যা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাধারণ সদর দপ্তরের অধীনে কাজ করে। এর মূল কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সামরিক কমান্ডকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা। আমানের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • ইউনিট ৮২০০: এটি ইসরায়েলি গোয়েন্দা ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে গোয়েন্দা তৎপরতা পরিচালনা করে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মতে, এটি তাদের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট, যেখানে ১০ হাজারের বেশি এলিট ও শিক্ষিত কর্মী কাজ করেন। এই ইউনিট যোগাযোগ ব্যবস্থার ওয়্যারট্যাপিং, সামরিক তথ্য ডিকোড করা, সাইবার হুমকি শনাক্ত করা এবং সাইবার ডিভাইস তৈরির কাজ করে। এটি প্রযুক্তির দিক থেকে আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার (NSA) সমতুল্য। ২০১০ সালে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় স্টাক্সনেট ভাইরাসের সাইবার হামলায় এই ইউনিটের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
  • ইউনিট ৯৯০০: যদি ৮২০০ ইসরায়েলের ‘কান’ হয়, তবে ৯৯০০ তার ‘চোখ’। এই ইউনিটের দায়িত্ব ছবি ও ভিডিও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা, যার জন্য তারা স্যাটেলাইট, গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন ব্যবহার করে। তারা থ্রিডি মানচিত্র তৈরি করে এবং ‘হরাইজন ১৩’ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইরানকে পর্যবেক্ষণ করে।
  • ইউনিট ৫০৪: মানুষের মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য গঠিত এই ইউনিট দেশের ভেতরের হুমকি নজরে রাখে এবং ইসরায়েলের বাইরেও গুপ্তচর নিয়োগ করে। গাজা ও অন্যান্য দেশে তাদের কর্মী সক্রিয় থাকে এবং শত শত সফল অভিযান চালিয়েছে।

‘ব্রাঞ্চ ৫৪’: ইরানের বিরুদ্ধে নতুন তাস?

২০২৩ সালের জুনে ইসরায়েলি গণমাধ্যমে ‘ব্রাঞ্চ ৫৪’ নামে এক নতুন গোয়েন্দা ইউনিটের খবর প্রকাশিত হয়। এই ইউনিটের কাজ ইরান এবং ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (পাসদারান-ই-ইনকিলাব) সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়া। এটি ইরানের সামরিক কার্যক্রম ও প্রশিক্ষণ কৌশল সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে। এই ইউনিটের এক কমান্ডার বলেছেন, “ব্রাঞ্চ ৫৪ প্রতিষ্ঠা এই ইঙ্গিত দেয় যে, ইরানি সামরিক হুমকি সম্পর্কে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর চিন্তা-ভাবনায় পরিবর্তন এসেছে।” তারা ইরানের অনেক লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করেছে এবং সম্ভাব্য যেকোনো সামরিক সংঘর্ষ সম্পূর্ণ ভিন্ন রকমের হবে বলে মনে করে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইরানে সাম্প্রতিক হামলায় এই ইউনিট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ইসরায়েলের এই সুসংগঠিত এবং প্রযুক্তিনির্ভর গোয়েন্দা কাঠামোই তাদের শত্রুদের বিরুদ্ধে সফল অভিযানের মূল চালিকা শক্তি। তবে এই ‘অদৃশ্য যুদ্ধ’ কতটা বিধ্বংসী হতে পারে, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy