
ভারতের শীর্ষ টেলিকম কোম্পানি রিলায়েন্স জিও এবং ভারতী এয়ারটেল আলাদাভাবে ইলন মাস্কের স্পেসএক্সের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তির মাধ্যমে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা ভারতে চালু হওয়ার পথ প্রশস্ত হয়েছে। এই পদক্ষেপ বিশ্লেষকদের অবাক করেছে, কারণ সম্প্রতি মাস্ক এই দুই কোম্পানির সঙ্গে স্পেকট্রাম বরাদ্দ নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়িয়েছিলেন। তবে, ভারত সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এবং মাস্কের প্রভাব এই অংশীদারিত্বের পথ সুগম করেছে।
সমঝোতার সময় ও পটভূমি
এই চুক্তি এমন এক সময়ে স্বাক্ষরিত হয়েছে যখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি হুমকি দিয়েছেন, আগামী ২ এপ্রিল থেকে ভারতের বিরুদ্ধে পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হবে। এর মধ্যেই স্টারলিংকের জন্য ভারত সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এই প্রকল্প। ২০২১ সাল থেকে স্পেসএক্স ভারতে সেবা চালুর চেষ্টা করে আসছে, কিন্তু নিয়ম-কানুনের জটিলতায় তা বিলম্বিত হয়েছে।
জিও ও এয়ারটেলের পরিকল্পনা
জিও এবং এয়ারটেল জানিয়েছে, তারা তাদের বিদ্যমান মোবাইল নেটওয়ার্কের সঙ্গে স্টারলিংকের প্রযুক্তি একত্রিত করে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড সেবা পৌঁছে দেবে। জিও তার দোকান ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে স্টারলিংক ডিভাইস বিক্রি করবে এবং ইনস্টলেশনের সুবিধা প্রদান করবে। এয়ারটেলও একই ধরনের পরিষেবা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। এছাড়া, এয়ারটেল ইতিমধ্যে স্টারলিংকের প্রতিদ্বন্দ্বী ইউটেলস্যাট ওয়ানওয়েবের সঙ্গেও কাজ করছে।
স্পেকট্রাম বিতর্কে মাস্কের জয়
এই চুক্তি অনেকের কাছে অপ্রত্যাশিত, কারণ জিওর মালিক মুকেশ আম্বানি এবং এয়ারটেলের মালিক সুনীল ভারতী মিত্তল স্যাটেলাইট স্পেকট্রাম নিলামের পক্ষে ছিলেন। অন্যদিকে, মাস্ক প্রশাসনিক বরাদ্দের দাবি জানিয়েছিলেন। গত অক্টোবরে ভারত সরকার ঘোষণা করে, স্পেকট্রাম প্রশাসনিকভাবে বরাদ্দ হবে—যা মাস্কের জন্য বড় জয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পর মাস্কের ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ওয়াশিংটনে বৈঠকের ফলে চুক্তির প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
প্রযুক্তি বিশ্লেষক প্রসান্ত কে রায় বলেন, “মার্কিন প্রশাসনে মাস্কের প্রভাব অপরিসীম। সম্ভবত এই কারণেই ভারত সরকার জিওর নিলামের প্রস্তাব উপেক্ষা করে মাস্কের দাবি মেনেছে।”
ভারতের ইন্টারনেট বাজারে সুযোগ
ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ইন্টারনেট বাজার, যেখানে ১৪০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৬৭ কোটি মানুষ এখনো ইন্টারনেটের আওতার বাইরে। স্টারলিংকের স্যাটেলাইট প্রযুক্তি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংযোগ স্থাপনের ক্ষেত্রে গেম-চেঞ্জার হতে পারে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, স্টারলিংকের বিশ্বব্যাপী ৪৬ লাখ গ্রাহক রয়েছে। বিশ্লেষক তরুণ পাঠক বলেন, “অনুমোদন পেলে স্টারলিংক ভারতের মোট মোবাইল ব্যবহারকারীর ৭০ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।”
দামের চ্যালেঞ্জ
তবে ভারতের বাজারে দাম একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণ মোবাইল ইন্টারনেটের খরচ যেখানে মাসে ১৫০ টাকা (প্রায় ২ ডলার), সেখানে স্টারলিংকের বর্তমান মাসিক খরচ ১৫০ ডলার (প্রায় ১২,৫০০টাকা)। বিশ্লেষকদের মতে, জিও ও এয়ারটেলের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ফলে এই দাম ৩,০০০ টাকার কাছাকাছি নামানো সম্ভব হতে পারে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এই চুক্তি ভারতের ডিজিটাল বিপ্লবের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে। জিওর গ্রুপ সিইও ম্যাথু উমেন বলেন, “স্টারলিংকের সঙ্গে আমাদের এই সহযোগিতা প্রতিটি ভারতীয়ের জন্য নিরবচ্ছিন্ন ব্রডব্যান্ড সংযোগ নিশ্চিত করবে।” এয়ারটেলের এমডি গোপাল বিট্টালও বলেন, “এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংযোগের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ।”
স্টারলিংকের ভারতে প্রবেশ শুধু ইন্টারনেট সেবার পরিধি বাড়াবে না, বরং জিও ও এয়ারটেলের মতো টেলিকম জায়ান্টদের সঙ্গে প্রতিযোগিতাকে নতুন মাত্রা দেবে। তবে, সরকারি অনুমোদন এবং দামের সামঞ্জস্যই এই প্রকল্পের সাফল্য নির্ধারণ করবে।
সূত্র: বিবিসি