
কঠিন সময়ে মানুষের মনকে কিছুটা হলেও সহজ করতে পারে পছন্দের গান। বিশেষ করে শোক, দুঃখ ও দুর্দশার মতো সংবেদনশীল পরিস্থিতিতে এসব গানের কথা মানুষের মানসিক অবস্থা সামাল দিতে সাহায্য করে বলে উঠে এসেছে নতুন এক আন্তর্জাতিক গবেষণায়। ‘হিব্রু ইউনিভার্সিটি অফ জেরুজালেম’-এর গবেষকদের করা এই গবেষণাটি বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল ‘ফ্রন্টিয়ার্স ইন সাইকোলজি’তে প্রকাশ পেয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, দুঃখে, জনবিচ্ছিন্ন বা অতিমাত্রায় চাপের মধ্যে থাকলে মানুষ কেবল মনঃসংযোগের জন্যই গান শোনেন না, বরং তারা এমন ধরনের গান শোনেন, যে গানের কথা তাদের মনের অনুভূতির প্রতিফলন ঘটাতে সাহায্য করে এবং পরিস্থিতি বুঝতে সহায়তা করে।
এই গবেষণাটি করেছেন হিব্রু ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক রেনানা পেরেজ ও আদি লেভি এবং সংগীত বিভাগের অধ্যাপক রনি গ্রানোট। গবেষণার জন্য ১১টি দেশের মানুষের বেছে নেওয়া দুই হাজার আটশটিরও বেশি গান বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা। এই গানগুলো মূলত কোভিড-১৯ লকডাউনের সময় শোনা হয়েছিল, যখন বিশ্বজুড়ে মানুষ কমবেশি মানসিক চাপ ও একাকিত্ব অনুভব করছিলেন।
অংশগ্রহণকারীদের এমন গান বেছে নিতে বলা হয়েছিল যা তাদের সেই সময়ের মানসিক চাপ সামলাতে সহায়তা করেছিল। সেইসব গানের কথা বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখেছেন সেখানে স্পষ্ট কিছু প্রবণতা বা ধারা আছে। যেমন– যারা দুঃখ বা ব্যক্তিগতভাবে চাপের সঙ্গে লড়ছিলেন তারা সাধারণত এমন গান বেছে নিয়েছেন যেখানে শোক, জীবন-মৃত্যু ও আত্মচিন্তার মতো গভীর বিষয় রয়েছে। অন্যদিকে, যারা একাকিত্ব অনুভব করছিলেন, তারা এমন গানের কথা পছন্দ করেছেন যেখানে সম্পর্ক, আপন মানুষদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কথা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে লিখেছে বিজ্ঞানভিত্তিক সাইট নোরিজ।
গবেষণায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উঠে এসেছে যে, গানের সুর বা গতি, তাল বা রাগের চেয়েও গানটির কথার আবেগপূর্ণ ভাব বা মেজাজ মানুষকে বেশি প্রভাবিত করেছে। গবেষণাটি ইঙ্গিত দিয়েছে যে, গান হয়তো মানুষকে শুধু অনুভব করতে সাহায্য করে, কিন্তু গানের কথা তাদের সেইসব অনুভূতিকে বুঝতে ও মানসিকভাবে গুছিয়ে নিতে সাহায্য করে। গানের কথা এক ধরনের ‘আবেগের ভরকেন্দ্র’ হিসেবে কাজ করে, যা এমন সব অনুভূতির ভাষা ও কাঠামো দেয়, যেগুলো অনেক সময় মুখে বলা বা অন্যকে বোঝানো কঠিন হয়ে পড়ে।
অধ্যাপক গ্রানোট বলেছেন, “এ গবেষণায় উঠে এসেছে, মানুষ গানকে এক ধরনের আবেগ সামলানোর টুল হিসেবে ব্যবহার করে। গানের কথা মানুষের দুঃখ, আশা বা আকাঙ্ক্ষার মতো গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে সাহায্য করে, বিশেষ করে যখন মানুষ নিজেরাই ঠিকভাবে সেইসব অনুভূতি প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায় না।”
প্রথমবারের মতো বড় পরিসরে গানের কথার সঙ্গে মানুষের আবেগ সামলানোর সম্পর্ককে সরাসরি যুক্ত করেছে এ গবেষণা। গান কীভাবে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সহায়ক ভূমিকা রাখে তা নতুনভাবে বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে এটি। গবেষকরা বলছেন, গান কেবল শুনে ভালো লাগার জন্য নয়, বরং মানসিকভাবে ভালো থাকার জন্যও খুব দরকারি এবং অনেকেই এটিকে নিজের যত্ন নেওয়ার এক উপায় হিসেবে ব্যবহার করেন।
অধ্যাপক পেরেস গবেষণার বাস্তব দিকটির ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন, “এখন আমাদের কাছে প্রমাণ রয়েছে যে, আবেগ সামলাতে গানের কথা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। গাননির্ভর থেরাপি, শোক কাটাতে সহায়তা, মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য বিভিন্ন স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম যেভাবে প্লেলিস্ট তৈরি করে– এ সব কিছুতেই পরিবর্তন আনতে পারে এ গবেষণা।”