
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে চরম উত্তেজনার পারদ চড়িয়ে ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে শুরু হয়েছে এক নজিরবিহীন সরাসরি সংঘাত। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ নামে ইরানে সামরিক অভিযান শুরু করার পর, এর জবাবে ইরানের সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি’ নামে পাল্টা আক্রমণ চালাচ্ছে। গত শুক্রবার থেকে শুরু হওয়া এই সংঘাতে ইরানি বাহিনী পাঁচ দফায় ইসরায়েলি ভূখণ্ড লক্ষ্য করে শত শত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন নিক্ষেপ করেছে।
বিশেষজ্ঞরা এই সংঘাতকে অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভয়াবহ বলে অভিহিত করছেন। ১৯৮০-১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর ইরানের ভূখণ্ডে চালানো এটিই সবচেয়ে বড় হামলা বলে মনে করা হচ্ছে। দুই চিরবৈরী আঞ্চলিক শক্তির মধ্যে এই সরাসরি সংঘাত আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা তৈরি করেছে, কারণ সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে উভয় দেশই বেশ শক্তিশালী।
সামরিক সক্ষমতায় কে কোথায় দাঁড়িয়ে?
‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইরান ইসরায়েলের চেয়ে তিন ধাপ এগিয়ে রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী সামরিক শক্তিধর দেশের শীর্ষ ২০টি দেশের মধ্যে উভয় দেশেরই অবস্থান রয়েছে। র্যাঙ্কিংয়ে ইরানের অবস্থান ১৪তম এবং ইসরায়েলের ১৭তম।
আসুন দেখে নেওয়া যাক, সামরিক শক্তির বিভিন্ন দিক থেকে দুই দেশের তুলনামূলক চিত্র:
• প্রতিরক্ষা বাজেট: প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। তবে বার্ষিক সামরিক বাজেটে ইসরায়েলের ব্যয় ইরানের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি।
- ইসরায়েল: ২ হাজার ৪৪০ কোটি ডলার (র্যাঙ্কিং: ১৯তম)
- ইরান: ৯৯৫ কোটি ডলার (র্যাঙ্কিং: ৩৩তম)
• নিয়মিত সৈন্য: সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে ইসরায়েলের চেয়ে ইরান এগিয়ে।
- ইরান: নিয়মিত সেনা ১১ লাখ ৮০ হাজার, রিজার্ভ সাড়ে তিন লাখ।
- ইসরায়েল: নিয়মিত সেনা ৬ লাখ ৭০ হাজার, রিজার্ভ ৪ লাখ ৬৫ হাজার।
• যুদ্ধবিমান: যুদ্ধবিমানের মোট সংখ্যায় ইসরায়েল এগিয়ে থাকলেও, আক্রমণের ক্ষমতার দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে।
- মোট সামরিক বিমান: ইসরায়েল ৬১২টি, ইরান ৫৫১টি।
- যুদ্ধবিমান: ইসরায়েল ২৪১টি, ইরান ১৮৬টি।
- অ্যাটাকিং বিমান: ইসরায়েল ৩৯টি, ইরান ২৩টি।
- পরিবহন বিমান: ইরান ৮৬টি, ইসরায়েল ১২টি।
- প্রশিক্ষণ বিমান: ইসরায়েল ১৫৫টি, ইরান ১০২টি।
• হেলিকপ্টার: হেলিকপ্টার সংখ্যায় ইসরায়েল সামান্য এগিয়ে এবং অ্যাটাক হেলিকপ্টার সক্ষমতায় তারা শক্তিশালী।
- মোট হেলিকপ্টার: ইসরায়েল ১৪৬টি, ইরান ১২৯টি।
- অ্যাটাক হেলিকপ্টার: ইসরায়েল ৪৮টি, ইরান ১৩টি।
• ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান: ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যানের দিক থেকে ইরান এগিয়ে।
- ট্যাঙ্ক: ইরান ১ হাজার ৯৯৬টি, ইসরায়েল ১ হাজার ৩৭০টি।
- সাঁজোয়া যান: ইরান ৬৫ হাজার ৭৬৫টি, ইসরায়েল ৪৩ হাজার ৪০৩টি।
- আর্টিলারি সক্ষমতা: ইরান রকেট আর্টিলারি (এমএলআরএস) ৭৭৫টি, সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি ৫৮০টি। ইসরায়েল সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি ৬৫০টি, এমএলআরএস ১৫০টি।
• নৌ শক্তি: নৌবাহিনীর শক্তিতে ইরান অনেকটাই এগিয়ে।
- মোট যুদ্ধজাহাজ: ইরান ১০১টি, ইসরায়েল ৬৭টি।
- ফ্রিগেট: ইরান ৭টি, ইসরায়েলের নেই।
- টহল জাহাজ: ইরান ২১টি, ইসরায়েল ৪৫টি।
- সাবমেরিন: ইরান ১৯টি, ইসরায়েল ৫টি।
• পারমাণবিক শক্তি: সুইডেন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (এসআইপিআরআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের কাছে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। তবে এই তালিকায় ইরানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র থাকার কথা উল্লেখ নেই। যদিও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারবার দাবি করেছে যে, ইরান তাদের ইউরেনিয়ামের মজুদ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। ইরান অবশ্য তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে। ‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’ তাদের রিপোর্টে পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করেনি।
সামগ্রিকভাবে, যদিও সামরিক বাজেট এবং কিছু নির্দিষ্ট সামরিক সরঞ্জাম যেমন যুদ্ধবিমান ও অ্যাটাক হেলিকপ্টারে ইসরায়েল এগিয়ে, তবে সৈন্য সংখ্যা, ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া যান এবং নৌ শক্তিতে ইরান বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। এই ব্যাপক সামরিক সক্ষমতা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরো বিশ্বের নজর এখন এই সংঘাতের দিকে, কারণ এর আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
সূত্র: বিবিসি।