সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ সরকারকে যখন উৎখাত করা হলো তখন সেটা শুধু তার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেশ শাসনের ২৪ বছর নয়; বরং এর মধ্য দিয়ে তার পরিবারের ৫০ বছরের শাসনের অবসান ঘটেছে। বাশার আল-আসাদ ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তারা বাবা হাফিজ আল আসাদ তিন দশক ধরে দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
দেশটিতে এখন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করছে। আর একই সঙ্গে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট, তার স্ত্রী ও সন্তানদের ভবিষ্যৎ। তারা এখন রাশিয়ায়। সেখানে তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সামনে কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য?
• রাশিয়ায় পালালেন কেন আসাদ?
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে রাশিয়া ছিল আসাদের কট্টর মিত্র। দেশটিতে রাশিয়ার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি আছে। ২০১৫ সালে আসাদের সমর্থনে বিমান হামলা চালিয়েছিল রাশিয়া; যা যুদ্ধের ঢেউ সরকারের পক্ষে নিয়ে এসেছিল।
যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক একটি পর্যবেক্ষক সংস্থার মতে, তখনকার ৯ বছরে রাশিয়ার সামরিক অভিযানে ২১ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৮ হাজার ৭০০ জন ছিলেন বেসামরিক নাগরিক।
কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার মনোযোগ সরে যায়। দেশটি হয়তো এবার নভেম্বরে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অভিযান শুরুর পর আসাদ সরকারকে সহায়তায় অনিচ্ছুক কিংবা অক্ষম হয়ে পড়ে।
বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রুশ সরকারি গণমাধ্যম খবর দেয়, আসাদ ও তার পরিবার মস্কোয় এসে পৌঁছেছে এবং মানবিক বিবেচনায় তাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়া হবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সোমবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘‘অবশ্যই এ ধরনের সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রপ্রধানকে ছাড়া হয় না। এটা তারই সিদ্ধান্ত।’’
রাশিয়ার সঙ্গে আসাদের সম্পর্ক, বিশেষ করে মস্কোর সম্পর্কের যথেষ্ট প্রমাণ আছে। দ্য ফিনান্সিয়াল টাইমস ২০১৯ সালের অনুসন্ধানে মস্কোতে আসাদ পরিবারের ১৮টি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের খোঁজ পেয়েছিল। গৃহযুদ্ধের সময় কোটি কোটি ডলার সিরিয়ার বাইরে রাখার চেষ্টার অংশ হিসেবে এসব অ্যাপার্টমেন্ট কেনা হয়েছিল।
আসাদের বড় ছেলে হাফিজ পিএইচডি করছেন সেখানে। স্থানীয় গণমাধ্যম খবর দিয়েছে, গত সপ্তাহেই তার সেখানে ডক্টরাল ডিসার্টেশন ছিল। অন্যদিকে রুশ টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, মস্কোর কর্মকর্তারা সিরিয়ার সশস্ত্র বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে; যাতে রাশিয়ার ঘাঁটি ও কূটনৈতিক মিশনের কোনও ক্ষতি না হয়।
• আসাদের স্ত্রী ও সন্তান কারা
আসাদের স্ত্রী আসমা ব্রিটেন ও সিরিয়ার দ্বৈত নাগরিক। বাবা-মা সিরিয়ান হলেও তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা পশ্চিম লন্ডনে। ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হওয়ার আগে তিনি লন্ডনেই স্কুল ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করেছেন।
তিনি ২০০০ সালে পাকাপাকিভাবে সিরিয়ায় চলে আসেন এবং আসাদকে বিয়ে করেন। আসাদ তার আগেই পিতার মৃত্যুজনিত কারণে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
dhakapost
ড. নাসরিন আলরেফাই লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সেসের ভিজিটিং ফেলো। তিনি বিবিসি নিউজকে বলেছেন, ‘‘আসমার ব্রিটিশ পাসপোর্ট আছে। সুতরাং তিনি রাশিয়ায় না থেকে যুক্তরাজ্যেও ফিরতে পারবেন।’’
‘‘তবে যুক্তরাষ্ট্র তার বাবা ড. ফাওয়াজ আল-আখরাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। তিনিও রাশিয়ায় আছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।’’ তবে তার মতে, আসমা এখন হয়তো রাশিয়াতেই থাকতে চাইবেন।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইলের খবরে প্রতিবেশীর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আসমার বাবা একজন কার্ডিওলজিস্ট আর মা সাহার একজন অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিক। তারা মস্কোতেই অবস্থান করতে চেয়েছেন; যাতে এ সময় তাদের মেয়ে ও মেয়ে জামাইয়ের পাশে থাকতে পারেন।
আসাদ দম্পতির তিন সন্তান, হাফিজ, জেইন আর কারিম। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ২০২২ সালে কংগ্রেসে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলেছিল, আসাদ পরিবারের এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলারের সম্পদ আছে। যদিও মনে রাখা দরকার, এটা হিসেব করা কঠিন। কারণ তাদের সম্পদ বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট প্রোপার্টি, করপোরেশন কিংবা অফশোর কোম্পানির অ্যাকাউন্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আসাদ ও আসমা সিরিয়ার অর্থনীতির বড় বড় খেলোয়াড়দের ঘনিষ্ঠ। তাদের কোম্পানি ব্যবহার করে তারা অর্থ পাচার করেছেন কিংবা অবৈধভাবে অর্থ আয় করেছেন। এমনকি সিরিয়ার অর্থনৈতিক সংকট নিরসনে যে কমিটি করা হয়েছে সেখানে আসমার প্রভাব ছিল।
dhakapost
সেই কমিটি সিরিয়ার খাদ্য ও জ্বালানি ভর্তুকি, বাণিজ্য ও মুদ্রার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতো। এছাড়া সরকারি বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকা পুনর্গঠনে যেসব বিদেশি সাহায্য এসেছে সেটি দেখভাল করতো সিরিয়া ট্রাস্ট ফর ডেভেলপমেন্ট। এতেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন আসমা।
সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আসমাকে স্বামী ও পরিবারের সহায়তায় সিরিয়া যুদ্ধের সবচেয়ে লাভবানদের একজন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসনের আরেকজন কর্মকর্তা তাকে ‘পরিবারের ব্যবসায়িক প্রধান’ এবং ‘একজন অলিগার্ক’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।
তিনি বাশারের চাচাতো ভাই রামি মাখলৌফের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছিলেন। তিনি সিরিয়ার অন্যতম ধনী মানুষ। তার চিকিৎসা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অভিযোগের পর তাদের পরিবারের ভাঙনের বিষয়টি সামনে চলে আসে।
• বিচারের মুখোমুখি হবেন আসাদ?
আসাদের পতনের পর অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব বলেছেন, সিরিয়ার মানুষ ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের স্বীকার হয়েছেন এবং এর ফলে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় হয়েছে।
এর মধ্যে রাসায়নিক অস্ত্র ও ব্যারেল বোমা হামলাসহ বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাপরাধের ঘটনা রয়েছে। এর সঙ্গে হত্যা, নির্যাতন, গুম, খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধও আছে। তিনি আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘনের তদন্ত এবং বিচার নিশ্চিতের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়েছেন।
সিরিয়ার ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের নেতা বলেছেন, রাজনৈতিক বন্দিদের যারা নির্যাতন করেছে, তাদের নাম প্রকাশ করা হবে। আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি বলেছেন, অন্য দেশে পালিয়ে যাওয়া কর্মকর্তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবেন তারা।
ফ্রান্সে আসাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন দেশটির একজন বিচারক। ২০১৩ সালে রাসায়নিক হামলার হামলার অভিযোগে এই পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। রাশিয়া নিজের নাগরিকদের কখনও প্রত্যর্পণ করে না। তবে অন্য দেশের নাগরিকদের জন্য আইনি প্রক্রিয়া আছে। আসাদ রাশিয়া ছেড়ে অন্য এমন কোনও দেশে যাবেন না, যেখান থেকে তাকে সিরিয়ায় ফেরত পাঠানোর সুযোগ আছে কিংবা তাকে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হতে পারে।