
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু রাজ্যের প্রধান নন, তিনি পুলিশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও রয়েছেন। এই দ্বৈত ভূমিকার কারণে তাঁর সঙ্গে এক টেবিলে বৈঠকে বসতে রাজি নন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর অভিযোগ, আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় কলকাতা পুলিশ প্রমাণ লোপাট করেছে, এবং সেটা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরদারিতেই ঘটেছে। এই কারণে বিবেকের তাড়নায় তিনি পুলিশমন্ত্রীর সঙ্গে কোনও সরকারি বৈঠকে অংশ নিতে চান না বলে জানিয়েছেন শুভেন্দু।
আগামী ১৯ মার্চ তথ্য কমিশনার নিয়োগ নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সূত্রের খবর, এই বৈঠক বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে হতে পারে। তথ্য কমিশনার নিয়োগ কমিটিতে রয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় এবং বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। রাজ্যের প্রশাসনিক সংস্কার দপ্তর থেকে গত মঙ্গলবার শুভেন্দুকে চিঠি দিয়ে এই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তবে বৃহস্পতিবার জবাবি চিঠিতে শুভেন্দু স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি এই বৈঠকে যোগ দেবেন না।
শুভেন্দুর অবস্থান ও যুক্তি
শুভেন্দু তাঁর জবাবি চিঠিতে বৈঠক বয়কটের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “মুখ্যমন্ত্রীর হাতে পুলিশ দপ্তর রয়েছে। আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় কলকাতা পুলিশ তথ্য-প্রমাণ লোপাট করেছে। এটা পুলিশমন্ত্রীর নজরদারিতেই হয়েছে, যার ফলে তদন্তের গতি-প্রকৃতি অন্য দিকে ঘুরে গেছে।” তিনি আরও যোগ করেছেন, “যতক্ষণ এই ঘটনার আসল অপরাধীরা জেলে না যাচ্ছে, ততক্ষণ পুলিশমন্ত্রীর সঙ্গে এক টেবিলে বসা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়েই আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া
শুভেন্দুর এই অবস্থানের জবাবে তৃণমূল নেতৃত্ব পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নিলেও তার গুরুত্ব বাড়াতে চায়নি। রাজ্যের পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শুভেন্দুর কথার জবাব দিয়ে ওঁর গুরুত্ব বাড়াতে চাই না।” তবে এক তৃণমূল বিধায়ক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দাঁড়ানোর মতো মনোবল শুভেন্দু অধিকারীর নেই। তাই কোনও অজুহাত দিয়ে তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছেন।”
মমতা-শুভেন্দুর সম্পর্ক
গত চার বছরে মমতা ও শুভেন্দুর মধ্যে সরাসরি মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা খুবই কম। মাসখানেক আগে বিধানসভার লবিতে তাঁদের আচমকা দেখা হয়েছিল, তবে সৌজন্য বিনিময় ছাড়া কোনও বিশেষ কথা হয়নি। শুভেন্দু ২০২০ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পর থেকে তাঁরা কোনও সরকারি বৈঠকে একসঙ্গে অংশ নেননি। ২০২২ সালের নভেম্বরে মমতার আমন্ত্রণে শুভেন্দু বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়ে গিয়েছিলেন, তবে সঙ্গে অগ্নিমিত্রা পল, অশোক লাহিড়ীর মতো বিজেপি বিধায়কদের নিয়ে গিয়েছিলেন।
বিজেপির দৃষ্টিকোণ
এক বিজেপি বিধায়কের মতে, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুভেন্দুর মতো ভালো কম লোকই চেনেন। তথ্য কমিশনার নিয়োগের বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে তিনি ঠিক করেছেন। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে এক টেবিলে বসে চা খাওয়ার ছবি তৃণমূল পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিত। তাতে বিজেপির নিচুতলার কর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়ত। শুভেন্দু সেই ফাঁদে পা দেননি।”
রাজনৈতিক তাৎপর্য
শুভেন্দুর এই বৈঠক বয়কট রাজ্য রাজনীতিতে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। আরজি কর কাণ্ডে কলকাতা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে শুভেন্দু যে অভিযোগ তুলেছেন, তা তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর দীর্ঘদিনের সমালোচনারই অংশ। অন্যদিকে, তৃণমূলের পক্ষ থেকে এটিকে শুভেন্দুর ‘দুর্বলতা’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। ১৯ মার্চের বৈঠকটি শেষ পর্যন্ত কীভাবে এগোয়, তা রাজ্যের রাজনৈতিক মহলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।