
এক নতুন এবং গভীরতর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (ICG) এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের একাংশ এবার মিয়ানমারের বিদ্রোহী আরাকান আর্মির (AA) বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে নেমেছে। কক্সবাজার ও টেকনাফের শরণার্থী শিবির থেকে কিছু রোহিঙ্গা যুবক রাখাইন রাজ্যে হামলা চালাচ্ছে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় গড়ে তুলেছে প্রশিক্ষণ শিবির – যা আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য এক “বিপজ্জনক মোড়” বলে মনে করছে ICG।
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নৃশংস দমনপীড়নের মুখে প্রায় ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে মিয়ানমার সেনা এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই নতুন করে সংঘাতের মুখে পড়ে নিজেদের অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার্থে কিছু রোহিঙ্গা যুবক আবার অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বাস্তুচ্যুত এই জনগোষ্ঠী এখন মিয়ানমারের অভ্যন্তরেও আরাকান আর্মির সঙ্গে নতুন করে সংঘাতের সম্মুখীন হচ্ছে, যা তাদের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। ICG-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, এসব রোহিঙ্গা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি একত্রিত হয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’ ঘোষণা করেছে এবং শিবিরে তাদের সদস্য সংগ্রহ অভিযান জোরদার করেছে।
এই নতুন সশস্ত্র তৎপরতা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঢাকা দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ধাপে ধাপে প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু রাখাইন রাজ্য এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে।
ICG-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনায় বসতে আগ্রহী। এ বিষয়ে প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত খলিলুর রহমানকে দায়িত্বও দেওয়া হয়েছে। তবে, দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক চাপ এবং সামরিক নেতৃত্বের আপত্তির কারণে সরকার ‘মানবিক করিডোর’-এর প্রস্তাব থেকে আপাতত সরে এসেছে। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, এই সংঘাতের আঞ্চলিক প্রভাব কতটা গভীর হতে পারে এবং এর সমাধান কতটা জটিল।
ICG সতর্ক করেছে যে, এই রোহিঙ্গা বিদ্রোহ শুধু বাংলাদেশের জন্যই নয়, গোটা অঞ্চলের জন্যই বিপজ্জনক। রাখাইনে চলমান সংঘাত আরও তীব্র হলে তা রোহিঙ্গা বেসামরিক মানুষের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলবে এবং সংঘাত এড়াতে আরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হতে পারে। এর ফলে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ICG বাংলাদেশ সরকারকে শরণার্থী শিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা বন্ধ করতে এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে কার্যকর সংলাপের মাধ্যমে রাখাইন রাজ্যে স্থিতিশীলতা ফেরাতে আহ্বান জানিয়েছে। আরাকান আর্মির প্রতিও আহ্বান জানানো হয়েছে যাতে তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনা শুরু করে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং রোহিঙ্গা – এই তিন পক্ষের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছে ICG, অন্যথায় এই সংঘাত আরও গভীর হতে পারে।