
অসমে অবৈধ অভিবাসীদের চিহ্নিতকরণ ও দেশছাড়া করার প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত করতে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল (FT)-এর দীর্ঘসূত্রিতা এড়িয়ে এবার সরাসরি প্রশাসনিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশিদের বিতাড়িত করার কথা জানালেন তিনি। ১৯৫০ সালের Immigrants (Expulsion from Assam) নির্দেশ অনুযায়ী, এখন থেকে জেলা প্রশাসন নিজেই অবৈধ বিদেশিদের বহিষ্কার করতে পারবে। অর্থাৎ, কোর্টে মামলা ঝুলে না থাকলে সরাসরি ‘পুশব্যাক’ করার ক্ষমতা পাচ্ছে প্রশাসন।
হিমন্ত বিশ্বশর্মার দাবি, সুপ্রিম কোর্ট 6A ক্লজ মামলার শুনানিতে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে যে ১৯৫০ সালের অর্ডার এখনও বলবৎ রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জানান, এতদিন আইনজীবীরা এই বিষয়টি তুলে ধরেননি বলেই সরকার অবগত ছিল না। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (NRC) জটিলতার কারণে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার উভয়ই যখন ব্যাকফুটে, তখন বিজেপি সরকার একটি পুরোনো আইনকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ দেখাতে চাইছে।
বাংলাদেশ কি এবার সরাসরি নিশানায়?
অসমে ‘বিদেশি’ বলতে মূলত যাদের বোঝানো হয়, তাদের বৃহৎ অংশকে ‘বাংলাদেশি মুসলমান’ হিসাবেই প্রচারে তুলে ধরে বিজেপি। NRC প্রকাশের সময় থেকেই এই প্রচার চলেছে। হিমন্ত নিজেও একাধিকবার বলেছেন, “অসমে অনুপ্রবেশ করে জনসংখ্যার ভারসাম্য বদলে দেওয়া হচ্ছে।” ১৯৭১ সালের আগে যারা এসেছেন, তাদের নাগরিকত্ব সংরক্ষিত, কিন্তু বিজেপির রাজনৈতিক বক্তব্য অনুযায়ী, তারপরও প্রচুর বাংলাদেশি মুসলমান অসমে ঢুকেছেন। NRC-তে নাম বাদ যাওয়া ১৯ লক্ষের মধ্যে বড় অংশ ছিল মুসলমান—এই নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। তাই ১৯৫০ সালের আইন তুলে এনে প্রশাসনের হাতে সরাসরি ‘ডিপোর্ট’ করার ক্ষমতা তুলে দিলে, কার্যত টার্গেট হবে সেই তথাকথিত ‘অবৈধ বাংলাদেশিরাই’—বিশেষত যারা আদালতের আওতায় এখনো আসেননি।
মানবাধিকার সংগঠনগুলির আপত্তি: সংবিধান ও ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা
হিমন্তের এই সিদ্ধান্তে মানবাধিকার কর্মীরা কড়া আপত্তি তুলেছেন। তাদের অভিযোগ, একজন নাগরিককে ‘বিদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া এবং তাকে দেশে ফেরত পাঠানো এক গভীর আইনি সিদ্ধান্ত। আদালতের পর্যালোচনা ছাড়া প্রশাসনের হাতে এই ক্ষমতা থাকা সংবিধানবিরোধী। তাদের মতে, এই ক্ষমতা প্রয়োগে জাতিগত ও ধর্মীয় পক্ষপাতিত্বের সম্ভাবনা প্রবল। বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৫০ সালের অর্ডার বলবৎ হলেও তা ছিল দেশভাগ পরবর্তী বাস্তবতায়। এখন যেভাবে তা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা আদতে ‘আধুনিক বাংলাদেশি মুসলমান’ ইস্যুকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করারই চেষ্টা।
NRC ব্যর্থ, তাই বিকল্প পথ?
২০১৯ সালে NRC প্রকাশিত হলেও সরকার নিজেই তা প্রত্যাখ্যান করেছে। শোনা যায়, বহু হিন্দু অভিবাসীর নামও বাদ পড়ে যায়, যা বিজেপির পক্ষে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। তাই NRC আপাতত স্থগিত। অন্যদিকে, ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের গতি এত ধীর যে, কার্যত বহু মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। এই কারণেই মুখ্যমন্ত্রী এখন সরাসরি প্রশাসনিক আদেশে কাজ সারতে চাইছেন।
আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া
এই সিদ্ধান্তের প্রভাব ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও পড়তে পারে। যদিও সরকার স্পষ্ট করেনি যে ‘পুশব্যাক’ হলে তা ভারতের সীমান্ত পার করে বাংলাদেশে পাঠানো হবে, তবে তা পরোক্ষে বোঝানো হচ্ছে। আর এটাই ঢাকার পক্ষে উদ্বেগের। কারণ, অতীতে NRC ইস্যুতে বাংলাদেশ বলেছে, তারা কোনো অবৈধ অভিবাসীকে ফেরত নেবে না।
এই পদক্ষেপ আইনি দিক থেকে যতই যুক্তিযুক্ত হোক, বাস্তবে এটি একটি ‘রাজনৈতিক ঘোষণা’, যা ২০২৬ অসম বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। নাগরিকত্ব বিতর্ক, ধর্মীয় মেরুকরণ এবং বাংলাদেশি অভিবাসী নিয়ে দীর্ঘদিনের উদ্বেগ—সবকিছুকে এক প্যাকেজে বেঁধে বিজেপি এবার নতুন চাল খেলছে।