বাঁকুড়া, দামোদরের বুকে আজও নেই সেতুর পাকা গাঁথনি, লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা সংকটে

প্রতি বছর বর্ষা আসে, আর তার সাথে আসে বাঁকুড়ার শালতোড়া এবং পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল-বার্নপুরের মধ্যবর্তী দামোদর নদের ওপরের সেই কাঠের অস্থায়ী সেতুর ভাঙনের খবর। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ডিভিসি-র ছাড়া জলে আবার ভেসে গেছে সাঁকো, থমকে গেছে লক্ষাধিক মানুষের জীবনযাত্রা। এই দীর্ঘদিনের অবহেলা আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবার ফুঁসে উঠেছে শালতোড়ার প্রায় তিরিশটি গ্রাম, গড়ে উঠেছে ‘দামোদর বিহারীনাথ সেতু বন্ধন কমিটি’। প্রশাসনিক উদাসীনতা এবং জনপ্রতিনিধিদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির বিরুদ্ধে তারা আজ রাস্তায়।

অস্থায়ী সেতুর অভিশাপ: এক দশক ধরে চলা দুর্ভোগ
শালতোড়া ব্লকের বাসিন্দাদের কাছে আসানসোল-বার্নপুর যেন দ্বিতীয় ঘর। স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, হাটবাজার, কর্মক্ষেত্র—সবকিছুর জন্যই তাঁদের দামোদর পেরিয়ে যেতে হয়। কিন্তু এই পারাপারের পথটি যুগ যুগ ধরে এক অনিশ্চিত যাত্রা। বর্ষায় নদীর জল বাড়লে বাঁশ ও কাঠের তৈরি অস্থায়ী সেতুটি ভেঙে যায়। তখন একমাত্র ভরসা হয় ৩০-৩৫ কিলোমিটার ঘুরে ডিসেরগড় সেতু। প্রতিদিনের এই অতিরিক্ত পথচলায় শুধু সময় আর অর্থের অপচয়ই নয়, রুটিরুজি হারাতে বসেছেন বহু মানুষ। “আমাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পারে না, হাসপাতালে পৌঁছতে দেরি হয়, কাজ হারানোর ভয়,” ক্ষোভের সাথে জানালেন এক গ্রামবাসী।

প্রতিশ্রুতির মায়াজাল: কেন নড়ছে না প্রশাসনের টনক?
দীর্ঘদিনের এই দাবি পূরণের জন্য শালতোড়ার মানুষ বারবার আবেদন জানিয়েছেন প্রশাসনের কাছে, এমনকি কমিটি গঠন করে মিছিল, ধর্না, ডেপুটেশনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কমিটির সদস্যদের অভিযোগ, “প্রশাসনের টালবাহানায় আমাদের রুজিরুটি, চিকিৎসা, লেখাপড়া সব সংকটে পড়েছে।” তাঁরা আরও বলেন, “নির্বাচন এলেই সমস্ত রাজনৈতিক দল পাকা সেতুর যৌক্তিকতা স্বীকার করে প্রতিশ্রুতি দেয়, কিন্তু ভোটে জেতার পর কেউ কথা রাখে না।” এই ধারাবাহিক বঞ্চনার প্রতিবাদে তারা এবার ভোট বয়কটের মতো কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছেন।

দায় এড়ানোর পালা: কে জানে, কে জানে না!
সেতু নির্মাণ নিয়ে বিভিন্ন মহলে চলছে দায় এড়ানোর পালা। বাঁকুড়ার মহকুমা শাসক জানিয়েছেন, এই বিষয়ে তাঁর তেমন কিছু জানা নেই এবং তিনি খোঁজ নেবেন। পূর্ত দফতর অবশ্য কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছে। তারা জানিয়েছে, রাজ্যের মন্ত্রী এবং আসানসোল উত্তরের বিধায়ক মলয় ঘটক এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন এবং দফতরের ইঞ্জিনিয়াররা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণও করেছেন। কিন্তু এই আশ্বাস কবে বাস্তবে রূপ নেবে, তা নিয়ে সন্দিহান স্থানীয়রা। শালতোড়া পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতিও এই বিষয়ে কোনো স্পষ্ট উত্তর দিতে পারেননি, শুধু এটুকু বলেছেন যে, প্রতি বছর খেয়া পারাপারের জন্য দরপত্র ডাকা হয় এবং যারা তা পান, তারাই অস্থায়ী কাঠের সেতু তৈরি করে পারাপার করান। এই পরস্পরবিরোধী বক্তব্যগুলি স্থানীয়দের ক্ষোভকে আরও উস্কে দিচ্ছে।

আট কিলোমিটার বনাম ষাট কিলোমিটার: দুর্ভোগের চিত্র
দামোদর-বিহারীনাথ সেতু বন্ধন কমিটির সভাপতি সুবল চক্রবর্তী জানান, বাঁকুড়ার ঈশ্বরদা, দিঘি, শালতোড়া, কেশপুর, ভিতরডি, সরাগডি-সহ প্রায় ৩০টি গ্রাম এবং পশ্চিম বর্ধমানের বার্নপুর, কালাঝরিয়া, আসানসোল-সহ একাধিক এলাকার বাসিন্দারা এই অস্থায়ী সেতু পেরিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন। অস্থায়ী কাঠের সেতুটি দিয়ে মাত্র আট কিলোমিটার রাস্তা যেতে হয়, যেখানে মেজিয়া বা ডিসেরগড় সেতু পেরিয়ে গেলে প্রায় ৬০ কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে হয়। এই বিশাল দূরত্ব এবং সময়ের অপচয় তাঁদের নিত্যদিনের সঙ্গী। “বর্ষায় সেতুটি জলের তোড়ে ভেঙে গেলে যাতায়াত পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। ঝুঁকি নিয়ে বর্ষার উত্তাল দামোদর, খেয়ায় পারাপার করতে হয়,” আক্ষেপের সুরেই বলেন চক্রবর্তী।

বাঁকুড়ার শালতোড়ার মানুষের একটাই দাবি – দামোদরের বুকে একটি স্থায়ী সেতু। এই সেতু কেবল একটি কাঠামো নয়, এটি তাঁদের জীবন-জীবিকা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং উন্নয়নের মেরুদণ্ড। প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রতিশ্রুতির জাল ছিঁড়ে কবে এই অঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন সত্যি হবে, এখন সেটাই দেখার।

Related Posts

© 2025 News - WordPress Theme by WPEnjoy