
রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের সংশোধিত হারে বকেয়া মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) সংক্রান্ত মামলার শুনানি চলাকালীনই বুধবার রাজ্য সরকারকে তাৎপর্যপূর্ণ পরামর্শ দিল সুপ্রিম কোর্ট। বিচারপতি সঞ্জয় কারোল এবং বিচারপতি মনোজ মিশ্রের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বকেয়া ডিএ-র অন্তত ৫০ শতাংশ টাকা মিটিয়ে দেওয়ার কথা বলেছে বলে জানা গেছে। শীর্ষ আদালতের এই অবস্থানে রাজ্য সরকারের উপরে চাপ যে অনেকটাই বাড়ল, তা স্পষ্ট বলে মনে করছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার শীর্ষ আদালতে মামলাটি শুনানির জন্য উঠলে রাজ্য সরকারের বর্ষীয়ান কৌঁসুলি অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁর বদলে রাজ্যের হয়ে সওয়াল করেন আইনজীবী হুজ়েফা আহমেদি। শুনানির শুরুতেই বিচারপতি কারোলের পর্যবেক্ষণ ছিল, “আপনারা বকেয়া ডিএ–র অন্তত ৫০ শতাংশ রিলিজ় করুন।” এর উত্তরে আহমেদি যুক্তি দেন যে, রাজ্য সরকারের উপরে বিরাট আর্থিক বোঝা থাকা সত্ত্বেও তারা কর্মীদের জন্য ডিএ রিলিজ় করেছে। তারপরেও রাজ্য সরকারি কর্মীরা কেন্দ্রীয় পে কমিশনের সমতুল হারে ডিএ-র দাবি জানাচ্ছেন, যা রাজ্যের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয় এবং এটি বিরাট বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
তবে আদালত যে আহমেদির এই যুক্তিতে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট নয়, তা বিচারপতি কারোলের পরবর্তী মন্তব্যে স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি পরামর্শের সুরে বলেন, “আপনারা একটা কাজ করুন৷ আরও বেশি ডিএ দিয়ে দিন৷” যদিও এটি একটি পরামর্শ ছিল এবং আদালত এ দিন এই বিষয়ে কোনও লিখিত নির্দেশ জারি করেনি। বিচারপতি কারোলের এই পর্যবেক্ষণের সূত্র ধরে মামলাকারীদের অন্যতম আইনজীবী পিএস পাটোয়ালিয়া অভিযোগ করেন যে, রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তার কর্মীদের ন্যায্য প্রাপ্য ডিএ দিচ্ছে না। মামলাকারীদের আরেক বর্ষীয়ান আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য সরাসরি অভিযোগ করেন, রাজ্য এই মামলার শুনানি ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে দিতে চাইছে।
দীর্ঘ সওয়াল-জবাবের পর বিচারপতি কারোল জানান, মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানি এ দিন সম্ভব নয়। পরবর্তী শুনানি হবে আগামী শুক্রবার, ১৬ মে। তিনি স্পষ্ট করে দেন যে, যদি সে দিন রাজ্য সরকারের তরফে সওয়াল করার জন্য সিঙ্ঘভি উপস্থিত না থাকেন, তবে তাঁর পরিবর্তে আইনজীবী আহমেদকেই সওয়াল করতে হবে। এ দিনের শুনানি ধরলে শীর্ষ আদালতে ডিএ মামলার শুনানি বিভিন্ন কারণে অন্তত ১৮ বার পিছিয়ে গেল বলে মত আইনজীবীদের।
দেশের শীর্ষ আদালতের এ দিনের তুলনামূলকভাবে কড়া অবস্থানে সুপ্রিম কোর্টে মামলাকারী রাজ্য সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলির প্রতিনিধিরা খুশি হয়েছেন। মামলাকারী ‘কনফেডারেশন অফ স্টেট গভর্নমেন্ট এপ্লয়িজ়’-এর সাধারণ সম্পাদক মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা ডিএ মামলার ফয়সালা চাই। দিনের পর দিন রাজ্য মামলার শুনানি পিছিয়ে দেবে, এটা বরদাস্ত করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্মচারীরা এই মুহূর্তে ১৮ শতাংশ ডিএ পান৷ বাকি আছে ৩৭ শতাংশ৷ ষষ্ঠ বেতন কমিশন অনুযায়ী এই টাকা আমাদের ন্যায্য প্রাপ্য।” সংগঠনের সভাপতি শ্যামলকুমার মিত্রও একই সুরে কথা বলেন এবং জানান যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের এ দিনের অবস্থান তাদের আশাবাদী করছে।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় সরকারের মহার্ঘ ভাতার সমান হারে ডিএ দেওয়ার পাশাপাশি বকেয়া ডিএ প্রদানের দাবি জানিয়ে রাজ্য সরকারের কর্মীদের একাংশ কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করেছিলেন। কলকাতা হাইকোর্ট ২০২০ সালের ২০ মে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় যে, কেন্দ্রীয় সরকারের সমান হারে রাজ্য সরকারি কর্মীদেরও ডিএ দিতে হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে রাজ্য সরকার ২০২২ সালের ৩ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে পাল্টা মামলা দায়ের করে। ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর এই মামলার প্রথম শুনানি হয়। এর পর থেকে বিভিন্ন কারণে বারবার ডিএ মামলার শুনানি পিছিয়ে গিয়েছে, যা ‘তারিখ পে তারিখ’ পর্যায়ে চলে গেছে বলে আইনজীবীদের অভিযোগ। এই বিলম্বের মাঝেই বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কয়েক দফায় সরকারি কর্মচারীদের জন্য বাড়তি ডিএ-র ঘোষণা করেছেন। তারপরেও কেন্দ্রীয় হারের সঙ্গে রাজ্য সরকারের দেওয়া মহার্ঘ ভাতার হারে যথেষ্ট পার্থক্য থেকে গেছে।
এই পরিস্থিতিতে দেশের শীর্ষ আদালত আগামী শুক্রবার এই গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানিতে কী অবস্থান গ্রহণ করে, সে দিকেই এখন অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের একটি বড় অংশ। মামলার ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায়, তা স্পষ্ট হবে সে দিনই।