
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে দলবদল নতুন কিছু নয়, কিন্তু ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা কাশেম সিদ্দিকীর তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদে আসীন হওয়াকে কেন্দ্র করে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন গুঞ্জন শুরু হয়েছে। বছর দুয়েক আগেও যিনি ভাঙড়ের আইএসএফ বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর গ্রেফতারির পর রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নিয়মিত সরব হতেন, সেই কাশেমেরই হঠাৎ করে শাসকদলের এত বড় পদে আসা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে কি তৃণমূল কোনো বিশেষ চাল চালল?
নওশাদ-আব্বাস থেকে তৃণমূলের আঙিনায় কাশেম
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে নওশাদের দাদা পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকীর হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করেছিল আইএসএফ। একুশের ভোটে কংগ্রেস ও সিপিএমের সঙ্গে জোট করে ৩২টি আসনে লড়লেও আইএসএফ শুধুমাত্র ভাঙড়েই জয়লাভ করে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেই নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক মূলত তৃণমূলের সঙ্গেই ছিল এবং আইএসএফ তেমনভাবে তৃণমূলের ভোটে থাবা বসাতে পারেনি।
তবে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ধর্মতলায় আইএসএফের প্রতিষ্ঠা দিবসের কর্মসূচিতে পুলিশের উপর হামলা ও সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুরের অভিযোগে নওশাদ সিদ্দিকীর গ্রেফতারির পর ফুরফুরা শরিফের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক শীতল হয়। ৪১ দিন পর নওশাদ জামিন পাওয়ার পরই তৃণমূলের একাধিক নেতাকে ফুরফুরা শরিফে যেতে দেখা যায়, যা সম্পর্ক মেরামতের ইঙ্গিত দেয়।
এই পরিস্থিতিতেই সামনে আসেন নওশাদ ও আব্বাসের তুতো ভাই কাশেম সিদ্দিকী। একসময় ফুরফুরাতে তিনি তৃণমূল-বিরোধী হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং সিপিএমের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও কারো নজর এড়ায়নি। এমনকি, আইএসএফ গঠনের পর থেকে তিনি আব্বাস ও নওশাদকে পূর্ণ সমর্থন করে আসছিলেন এবং ২০২৩ সালে নওশাদের গ্রেফতারির পর নিয়মিত রাজ্য সরকারের কড়া সমালোচনা করতেন।
মুখ্যমন্ত্রীর ইফতার পার্টি থেকে নয়া পদ
সেই কাশেমকেই এ বছর মার্চে ফুরফুরা শরিফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে ইফতার পার্টিতে দেখা যায়। এই ইফতারে আব্বাস ও নওশাদ উপস্থিত না থাকলেও, মমতার পাশে কাশেমের উপস্থিতি রাজনৈতিক মহলে জল্পনা তৈরি করে। পরদিন কলকাতার পার্ক সার্কাসে আরেকটি ইফতারেও তাঁকে মমতার পাশে দেখা যায়। এরপরই প্রশ্ন ওঠে, ফুরফুরা শরিফের সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক উন্নয়নে কি এবার কাশেম সিদ্দিকী নেতৃত্ব দেবেন? এই জল্পনাই গত ৯ জুন বাস্তবে পরিণত হয়, যখন পীরজাদা কাশেম সিদ্দিকীকে তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ করা হয়।
কাশেমের বক্তব্য: ‘মানুষের জন্য কাজ করতে এসেছি’
এতদিন কোনো দলে সক্রিয়ভাবে দেখা না গেলেও, কাশেম তাঁর তৃণমূলে যোগদানের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, “২৮ বছর ধরে ধর্মসভা করছি। দেখেছি, একটা দলে না আসা পর্যন্ত কোনো মানুষের জন্য কোনো কাজ করা যাবে না। এইজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম, মানুষের জন্য কিছু কাজ করতে হবে। সেজন্য আমার দলে আসা। ফুরফুরা শরিফেও ঠিক ঠিক মতো কাজ হয়নি। মানুষ যাতে সঠিক কাজটা পায়, সেজন্য দলে আসা।”
ভবিষ্যতে কি তিনি তৃণমূলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হবেন? এই প্রশ্নের উত্তরে কাশেম দ্বিধাহীনভাবে বলেন, “যেখানে মানুষ বিপদে পড়েছে, সেখানে প্রতিবাদ করেছি। আগামিদিনেও মানুষ বিপদে পড়লে প্রতিবাদ করব।”
নওশাদ ও তৃণমূলেরই বিধায়কদের খোঁচা
কাশেমের তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নওশাদ সিদ্দিকী সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করেন। হাতে চায়ের কাপ ধরে নিজের ছবি দিয়ে লেখেন, “কাপে কিন্তু চা নেই।” পরে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ বলেন, “আমি ভাইয়েরও পক্ষে নই। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ভাই ঠিক করেছেন কি না, সেটা ভাই জবাব দেন।”
তৃণমূলের অন্দরেও কাশেমের যোগদান নিয়ে ভিন্ন সুর শোনা যাচ্ছে। ক্যানিং পূর্বের তৃণমূল বিধায়ক শওকত মোল্লা খোঁচা দিয়ে বলেন, “আমরা যারা তৃণমূল করি, তাদের নেত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর নেতার নাম অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফলে এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। দল যখন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে তাজা আলু হোক আর পচা আলু হোক, সেগুলো নিয়েই আমাদের চলতে হবে। এর বেশি আমি কিছু বলছি না।” ভরতপুরের তৃণমূল বিধায়ক হুমায়ুন কবীরও কটাক্ষ করে বলেন, “রাজনীতির অ, আ, ক, খ জানেন না কাশেম সিদ্দিকী। লালবাজারের সামনে তৃণমূল নেতৃত্বকে কী ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন, সবাই জানেন। এখন তাঁকে নেওয়ার পিছনে কী পরিকল্পনা রয়েছে, এটা ভবিষ্যৎ বলবে।”
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কি কাশেম সিদ্দিকী নওশাদের বিরুদ্ধে প্রার্থী হবেন? নাকি তৃণমূলের অন্য কোনো ‘পরিকল্পনা’ রয়েছে? এর উত্তর পেতে আরও কয়েক মাস অপেক্ষা করতে হবে। তবে, ফুরফুরার এই পীরজাদাকে ঘিরে রাজ্যের রাজনীতিতে যে নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে, তা বলাই বাহুল্য।