
আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণের ক্ষুদ্র দেশ বতসোয়ানায় অবস্থিত ‘জোয়ানেং’ নামের একটি হীরার খনিকে পৃথিবীর বৃহত্তম এবং সবচেয়ে মূল্যবান হীরার খনি হিসেবে গণ্য করা হয়। একটি প্রাচীন আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে অবস্থিত এই খনিটির বর্তমান বাজার মূল্য আনুমানিক ৯ হাজার ৬১৫ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় ৯৬.১৫ বিলিয়ন ডলার)। কেবল এর বিপুল উৎপাদন ক্ষমতা নয়, বতসোয়ানার অর্থনীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার পেছনেও এর অবদান অনস্বীকার্য।
বতসোয়ানার রাজধানী গ্যাবোরোন থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই খনিটি একটি বিরল আগ্নেয়গিরির শিলা ‘কিম্বারলাইট’ ঘনসন্নিবদ্ধ হয়ে তৈরি হয়েছে। কিম্বারলাইট হলো একটি ঘন, ভারী এবং খনিজে সমৃদ্ধ আগ্নেয়শিলা, যা পৃথিবীর আবরণের গভীরে গঠিত হয় এবং এতে হীরার উপস্থিতি এটিকে অত্যন্ত মূল্যবান করে তোলে। জোয়ানেঙের খনিটি মূলত কিম্বারলাইটের তিনটি উল্লম্ব কাঠামো বা পাইপ দিয়ে গঠিত, যা বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ হীরা উৎপাদন করে চলেছে।
‘রত্নপাথরের স্থান’ হিসেবে আক্ষরিক অর্থ বহনকারী ‘জোয়ানেং’ খনিটিকে তার গুরুত্ব এবং উৎপাদনের কারণে ‘খনির রাজপুত্র’ বলেও ডাকা হয়। শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই এই খনিটি ১৩৩ লক্ষ ক্যারাট (১৩.৩ মিলিয়ন ক্যারেট) হীরা উৎপাদন করেছিল, যা এর বিপুল উৎপাদন ক্ষমতাকে প্রমাণ করে এবং এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান হীরার খনিতে পরিণত করেছে।
এই খনিটি ১৯৭০ সালে বিশ্বখ্যাত হীরা সংস্থা ডি বিয়ার্সের হাতে আবিষ্কৃত হয়। এরপর বতসোয়ানা সরকার ও ডি বিয়ার্সের যৌথ উদ্যোগে গঠিত ‘ডেবসওয়ানা’ নামের একটি সংস্থার অধীনে ১৯৮২ সাল থেকে এখানে বাণিজ্যিকভাবে হীরা উত্তোলনের কাজ শুরু হয়। সেই থেকে প্রতি বছরই এই খনির বুক থেকে উঠে আসছে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সম্পদ। মনে করা হয়, বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান হীরাগুলির অনেকটির জন্ম হয়েছে এই খনির গর্ভেই।
হীরার খনি আছে এমন দেশের সংখ্যা ২৩ হলেও, রাশিয়া, বতসোয়ানা, কানাডা, দক্ষিণ আফ্রিকা, অ্যাঙ্গোলা ও নামিবিয়ার মতো মাত্র ছ’টি দেশে বড় আকারের হীরার সন্ধান মেলে। রাশিয়া উৎপাদনের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে এবং মোট বৈশ্বিক উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশ হীরা শুধু রাশিয়া জোগান দেয়। পৃথিবীর ৬০টি প্রধান হীরার খনির ১৭টিই রাশিয়ায় অবস্থিত। রাশিয়ার পরেই রয়েছে বতসোয়ানা, যা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম হীরে উৎপাদনকারী দেশ। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে আনুমানিক ৩০ কোটি ক্যারাট হীরে মজুত ছিল। ষাটের দশকে এই ক্ষুদ্র দেশটিতে একের পর এক হীরার খনি আবিষ্কৃত হওয়ার পর তার অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন আসে। ২০২১ সালেই ডেবসওয়ানা ডায়মন্ড নামের সংস্থা বতসোয়ানার খনি থেকে ১ হাজার ৯৮ ক্যারাটের মতো বিশাল আকারের হীরা উদ্ধার করেছিল।
জোয়ানেঙের এই হীরার খনিটি বতসোয়ানার অর্থনীতিতে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ডেবসওনার মোট আয়ের ৭০ শতাংশ আসে শুধু এই খনিটি থেকে। মনে করা হয়, খনি আবিষ্কারের পর থেকে এর মোট আয় ৯৬০০ কোটি টাকা (৯৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি) ছাড়িয়ে গেছে। এই অর্থনৈতিক অগ্রগতি বতসোয়ানাকে ১৯৬০ সালের পর থেকে বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ থেকে আজ একটি মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছে।
গোটা বিশ্বেই হীরার কদর অন্যান্য দামি পাথরের তুলনায় স্বতন্ত্র। মাটির অভ্যন্তরে থাকা কয়লা থেকে প্রচণ্ড চাপ ও তাপে হীরার সৃষ্টি হয়, যা একটি বেশ জটিল, কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। হীরার দাম ও গুণগত মানের তারতম্য ঘটে এর কাটের উপর। যে হীরে কেটেকুটে ঘষামাজা করে যত বেশি উজ্জ্বল ও ঝকঝকে করা যায়, তার কদর তত বাড়ে।
বর্তমানে বতসোয়ানা সরকার ও ডি-বিয়ার্সের মধ্যে নতুন একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে এবং খনির আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্য কাজ চলছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে এই খনির সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে এবং ‘কাট-৯’ নামে একটি বড় সম্প্রসারণ প্রকল্প চলছে, যার লক্ষ্য খনির আয়ুষ্কাল ২০৩৪ সাল পর্যন্ত বাড়ানো। বর্তমানে, খনিটি প্রায় ৪০০ মিটার গভীরতায় কাজ করে। জোয়ানেঙে খনির কাজ অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর। বড় বড় ড্রিল দিয়ে পাথর আলগা করা হয় এবং ট্রাকে করে প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় পরিবহণ করা হয়। এক্সরে এবং লেজার সর্টারের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে পাথর থেকে হীরে আলাদা করা হয়।
বর্জ্য পাথরের কারণে খনিটি কিছু পরিবেশগত সমস্যার মুখোমুখি হলেও, ২০০০ সালে এটিই বতসোয়ানার প্রথম খনি যা পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির জন্য আইএসও শংসাপত্র পেয়েছিল। আগামী কয়েক বছর ধরে এই খনিটি হাজার হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে এবং প্রায় ২০০০ কোটি পাউন্ড (মূল্যের) হীরে উৎপাদন করবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা বতসোয়ানার অর্থনীতিতে তার গুরুত্ব অটুট রাখবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি।