
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গত শনিবার (১০ মে, ২০২৫) রাতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও সাম্প্রতিক সংঘাত, যা ভারতে ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে পরিচিত, চলাকালীন পাকিস্তানের সামরিক সরঞ্জাম ব্যবহার নিয়ে নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে। একাধিক গণমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে যে পাকিস্তান এই সময়ে তাদের মার্কিন নির্মিত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করেছে। এমনকি কিছু অযাচাইকৃত খবরে একটি পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত এবং একজন পাইলটকে আটক করার কথাও বলা হয়েছে। এই ঘটনাগুলো পাকিস্তানের এফ-১৬ বহর ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহারের বৈধতা এবং এর উপর আরোপিত নিয়ম-কানুনকে সামনে এনেছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ:
পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর এফ-১৬ যুদ্ধবিমানগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফরেন মিলিটারি সেলস (FMS) প্রোগ্রামের আওতায় কেনা হয়েছে। এই বিক্রয় চুক্তির সাথে এন্ড-ইউজ মনিটরিং (EUM) নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি যুক্ত থাকে। এই চুক্তি অনুযায়ী, পাকিস্তান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়া এই যুদ্ধবিমানগুলি অবাধে ব্যবহার বা সেগুলিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। ব্যবহারের উপর কঠোর শর্ত আরোপ করা হয়েছে।
মার্কিন প্রযুক্তি যাতে অপব্যবহার না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য গোল্ডেন সেন্ট্রি এবং ব্লু ল্যান্টার্ন নামে দুটি বিশেষ প্রোগ্রামের অধীনে মার্কিন দল পাকিস্তানে মোতায়েন থাকে। এই দলগুলি বিমান এবং সেগুলির সঙ্গে সরবরাহ করা অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করে। এই কঠোর তদারকি পাকিস্তানের এফ-১৬ ব্যবহারের স্বাধীনতাকে সীমিত করে।
চুক্তিতে যা বলা আছে:
EUM চুক্তি অনুসারে, পাকিস্তান এফ-১৬ বা এর সঙ্গে সরবরাহকৃত AIM-120 AMRAAM মিসাইলের মতো আমেরিকান অস্ত্র প্রচলিত যুদ্ধে ব্যবহার করতে পারবে না, যদি না ওয়াশিংটন থেকে স্পষ্ট অনুমতি পাওয়া যায়। এই বিমানগুলি মূলত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের জন্য সরবরাহ করা হয়েছে, বিশেষ করে পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলীয় উপজাতি এলাকাগুলোতে ব্যবহারের জন্য। অন্য কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সরাসরি সংঘর্ষে, বিশেষ করে ভারতের মতো দেশের বিরুদ্ধে, এই বিমান ব্যবহারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। চুক্তিতে নির্দিষ্টভাবে ভারতের নাম উল্লেখ না থাকলেও, যুদ্ধের মতো পরিস্থিতিতে ভারতের বিরুদ্ধে এফ-১৬ ব্যবহার করা যাবে না, এটি একটি সুস্পষ্ট বোঝাপড়া।
২০১৯ সালের বিতর্ক:
এফ-১৬ ব্যবহার নিয়ে এটিই প্রথম বিতর্ক নয়। ২০১৯ সালে ভারতের বালাকোট বিমান হামলার পর মার্কিন কর্মকর্তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এফ-১৬ চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিলেন। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ফাঁস হওয়া কিছু নথি থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালের আগস্টে তৎকালীন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মুজাহিদ খানকে একটি তিরস্কারপত্র পাঠিয়েছিল। ওই পত্রে বলা হয়েছিল যে অনুমোদিত নয় এমন ঘাঁটিগুলিতে এফ-১৬ বিমান স্থানান্তর করে পাকিস্তান তাদের “যৌথ নিরাপত্তা” ঝুঁকির মুখে ফেলেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে আমেরিকা তাদের এই চুক্তি লঙ্ঘনের বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব সহকারে দেখে।
নিয়ম লঙ্ঘনের সম্ভাব্য পরিণতি:
যদি আবারও পাকিস্তান এফ-১৬ বিমানের অপব্যবহারের প্রমাণ মেলে, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দিতে পারে বা তাদের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি স্থগিত করতে পারে। যেহেতু এই বিমানগুলির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ এবং খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য পাকিস্তানকে আমেরিকান সরবরাহকারীদের উপর নির্ভর করতে হয়, তাই এমন কোনো পদক্ষেপ পাকিস্তানের বিমানবাহিনীর অপারেশনাল প্রস্তুতিকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। ওয়াশিংটনে কংগ্রেসের পক্ষ থেকেও এফ-১৬ ব্যবহারের উপর আরও কঠোর নজরদারির চাপ বাড়ছে, যা ভারতের বিরুদ্ধে এই বিমান ব্যবহারকে পাকিস্তানের জন্য আরও জটিল করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি:
যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে এফ-১৬ ব্যবহার করতে নিষেধ করেনি, তবে তাদের প্রত্যাশা স্পষ্ট। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে “সন্ত্রাসবিরোধী অংশীদার” হিসেবে এফ-১৬ সমর্থনের যৌক্তিকতা দিয়েছিল, প্রচলিত যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নয়। মার্কিন নীতির মূল ফোকাস এখনও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার উপর।
পাকিস্তানের এফ-১৬ বহর এবং সাম্প্রতিক সংঘাত:
২০২৫ সাল নাগাদ পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কাছে প্রায় ৭৫-৮০টি এফ-১৬ বিমান রয়েছে, যার বেশিরভাগই অপারেশনাল। তবে, এই বিমানগুলির ব্যবহার আমেরিকার কঠোর তদারকির আওতায় থাকায় পাকিস্তানের এই বহরের অপারেশনাল স্বাধীনতা সীমিত।
অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন পাকিস্তানের এফ-১৬ ব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদনে যে দাবি উঠেছে, তার মধ্যে ভারতীয় সূত্রে একটি এফ-১৬ ভূপাতিত এবং একজন পাইলটকে আটকের খবরও রয়েছে। তবে, পাকিস্তান এই ধরনের ক্ষয়ক্ষতির কথা অস্বীকার করেছে এবং এই দাবিগুলি এখনও স্বাধীনভাবে যাচাই করা হয়নি। যদি এফ-১৬ ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের চুক্তি লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হবে, যার গুরুতর পরিণতি হতে পারে।
এই সংঘাত আবারও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ক্ষেত্রে এফ-১৬ যুদ্ধবিমানের ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক সহযোগিতার প্রকৃতিকে সামনে এনেছে। চুক্তি অনুযায়ী ভারতের বিরুদ্ধে এই বিমান ব্যবহার না করার বাধ্যবাধকতা এবং নিয়ম লঙ্ঘনের সম্ভাব্য পরিণতির বিষয়টি আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।