পহেলগাঁওয়ের বদলা, বিশ্ব থেকে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের হুঙ্কার মোদীর

জম্মু ও কাশ্মীরের পহেলগামে নিরীহ পর্যটকদের উপর ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর সন্ত্রাসবাদকে পৃথিবী থেকে উপড়ে ফেলার দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার তাঁর দেওয়া বার্তাটি স্পষ্টতই ইঙ্গিত বহন করছে যে, কাশ্মীরে ধর্ম দেখে বেছে বেছে ২৬ জন মানুষকে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত এবার কঠোর অবস্থান নিতে চলেছে। সর্বদলীয় বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা আগে প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে এই ইস্পাত কঠিন সুর তাৎপর্যপূর্ণ। দেশের আপামর জনসাধারণ মনে করে, এই নারকীয় হামলার নেপথ্যে মূল দায় পাকিস্তানের। এই ইস্যুতে বিরোধী দল কংগ্রেস সহ প্রায় সব রাজনৈতিক দলই একমত পোষণ করেছে। এর থেকেও বড় বিষয় হলো, এই মুহূর্তে ভারতের জনমত প্রবলভাবে পাকিস্তানকে সমুচিত, দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার পক্ষে। এই জনমত প্রধানমন্ত্রী মোদীর হাতকে আরও শক্তিশালী করছে।

বৃহস্পতিবার বিহারের মধুবনীতে এক জনসভায় ভাষণ দেওয়ার সময় মোদী বলেন, ভারত জঙ্গিদের পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত তাড়া করে যাবে। হিন্দিতে বলছিলেন বলতে হঠাৎ ইংরেজিতে তাঁর সংযোজন – “pursue the terrorists to the end of the earth” (সন্ত্রাসবাদীদের পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত ধাওয়া করো)। মনে করা হচ্ছে, তাঁর এই বার্তাটি বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যেই তিনি ইংরেজি বাক্যটি ব্যবহার করেন। ২০০১ সালে আমেরিকায় ৯/১১ হামলার পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রায় একই ভাষায় হুঙ্কার দিয়েছিলেন। একইভাবে ইসরায়েলে হামাস জঙ্গিদের হামলার পর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছিলেন, জঙ্গিদের লুকিয়ে থাকা গর্ত থেকে টেনে বের করে নির্মূল করা হবে। বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী মোদীর মুখে যেন সেই একই প্রতিজ্ঞার প্রতিধ্বনি শোনা গেল।

প্রধানমন্ত্রী মোদীর এই কঠোর হুঁশিয়ারি মূলত দেশের জনগণের মনের কথাকেই তুলে ধরেছে। পহেলগামের ঘটনার পর দেশবাসী প্রতিশোধের আগুনে ফুঁসছে, বদলা চাইছে তারা। ইতিমধ্যেই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সরকারের যে কোনও পদক্ষেপে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে। ফলে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে আজ গোটা দেশ একমত যে এই হামলার মূল কুশীলব হল পাকিস্তান। এমনকি ভারত যে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে বৃহস্পতিবার সকালেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ ইসলামাবাদে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে জরুরি শলা-পরামর্শে বসেন। বোঝাই যাচ্ছে, ভারতের জনগণের মনোভাব বুঝতে পেরে পাকিস্তানও কিছুটা আতঙ্কে রয়েছে।

ভারতে যতগুলি বড় জঙ্গি হামলা হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটির পিছনেই পাকিস্তানের মদদ ছিল। শুধু কাশ্মীর নয়, খালিস্তানি জঙ্গিদেরও অর্থ ও অস্ত্র জুগিয়েছে পাকিস্তান। অনেক সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বা আইএসআইয়ের সরাসরি যোগসূত্রের প্রমাণ না মিললেও (যেমন পহেলগাম হামলায় এখনও স্পষ্ট প্রমাণ মেলেনি), ভারত বিরোধী সমস্ত ষড়যন্ত্রের শিকড় যে পাকিস্তানের মাটিতেই গভীরে প্রোথিত, তা নিয়ে দিল্লির কোনো সন্দেহ নেই। ভারত শত শতবার আন্তর্জাতিক মহলে এর প্রমাণ পেশ করেছে।

লস্কর-ই-তৈবা, জইশ-ই-মুহাম্মদের মতো কুখ্যাত জঙ্গি সংগঠনগুলোর প্রধান ঘাঁটিই হলো পাকিস্তান। এদের নেতারা সেখানে প্রকাশ্যেই বিচরণ করে, এমনকি জেলের ভিতরেও তারা বিশেষ সুবিধা পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। সেখান থেকেই তারা তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। আমেরিকা, রাষ্ট্রসংঘ সহ ইউরোপের বহু দেশ এদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও, পাকিস্তানের ভূমি ব্যবহার করে এদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ কখনও বন্ধ হয়নি।

৯/১১ হামলায় নিরীহ মানুষের মৃত্যুর পর আমেরিকা আল কায়দাকে নির্মূল করার শপথ নেয়। সিআইএ-র নেতৃত্বে দীর্ঘ ও নিরলস অভিযান চালিয়ে মার্কিন এলিট বাহিনী লাদেনকে খুঁজে বের করে নিকেশ করে। লাদেনের পর আল কায়দার দায়িত্বে আসা আল জাওয়াহিরি আফগানিস্তানের কাবুলে লুকিয়ে ছিল। আমেরিকার সরকার বদল হলেও তাকে রেহাই দেওয়া হয়নি; জো বাইডেনের নির্দেশে তার বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই তাকে হত্যা করা হয়। একইভাবে ইসরায়েলে হামাস জঙ্গিদের আক্রমণের পর মোসাদ এবং ইসরায়েলি এলিট বাহিনী গাজার সুড়ঙ্গের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হামাস নেতাদের খুঁজে বের করে খতম করে। লেবাননে একদিনে সিরিজ পেজার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মোসাদ বিশ্ব সন্ত্রাসবাদের মেরুদণ্ড কাঁপিয়ে দিয়েছিল। বর্তমানেও হামাস-সমর্থিত ইয়েমেনের হুতি জলদস্যুদের সঙ্গে আমেরিকার নৌবাহিনীর সংঘাত চলছে।

সুতরাং, বর্তমান পরিস্থিতিতে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভারতকে এমন পদক্ষেপ নিতে হবে যা পাকিস্তানকে শুধু ধাক্কাই দেবে না, বরং সমস্ত জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির এবং শীর্ষস্থানীয় জঙ্গি নেতাদের নির্মূল করতে সক্ষম হবে। জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ধরে রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলস্বরূপ, শুধু লস্কর বা জইশের মতো জঙ্গি সংগঠনগুলোই নয়, সমগ্র ভারতবাসী আজ পাকিস্তানকে একটি যোগ্য শিক্ষা দিতে চায়।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy