
পশ্চিমবঙ্গে প্রতিটি নির্বাচনেই ভুয়া ভোট ও ভোটার তালিকা নিয়ে অভিযোগ ওঠে। তবে এবার এই বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকেই রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি এই ইস্যুতে সরব হয়ে উঠেছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে অভিযোগ তোলেন যে, ভোটার পরিচয়পত্র বা এপিক কার্ডে একই নম্বরে একাধিক ভোটারের নাম রয়েছে। তিনি দাবি করেন, এই ভোটাররা কেউ পশ্চিমবঙ্গের, কেউ হরিয়ানার, আবার কেউ উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা। তিনি আরও বলেন, পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় অন্য রাজ্য থেকে প্রচুর ভোটদাতার নাম যুক্ত করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের নেতাদের অভিযোগ, নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে এই কাজ করাচ্ছে বিজেপি।
নির্বাচন কমিশনের প্রতিক্রিয়া
ভারতের নির্বাচন কমিশন স্বীকার করেছে যে, একই এপিক নম্বরে একাধিক ভোটদাতার নাম রয়েছে। তবে কমিশনের দাবি, এটি অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। এর ফলে ভুয়া ভোটারদের ভোট দেওয়ার পথ প্রশস্ত হচ্ছে এমন নয়। কমিশন জানিয়েছে, এপিক নম্বর এক হলেও তারা ভিন্ন রাজ্য বা ভিন্ন বিধানসভা ও লোকসভা এলাকার বাসিন্দা। ফলে হরিয়ানার ভোটদাতা পশ্চিমবঙ্গে এসে ভোট দিতে পারবেন না।
তবে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি প্রশ্ন তুলেছে, একই নম্বরে দুটি আধার কার্ড, প্যান কার্ড বা অন্য কোনো কার্ড হয় না, তাহলে ভোটার পরিচয়পত্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ কার্ডে এটি কীভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নের মুখে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, তারা দ্রুত ব্যবস্থা নেবে এবং একটি নম্বরে একটি পরিচয়পত্র নিশ্চিত করবে।
বিজেপি ও তৃণমূলের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ
দিন দুয়েক আগে তৃণমূলের ১০ জন সাংসদের একটি প্রতিনিধিদল দিল্লির নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে। তাদের অভিযোগ জানানোর কিছুক্ষণ আগেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও রাজ্য বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের নেতৃত্বে বিজেপির একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে দেখা করে।
সুকান্ত মজুমদার অভিযোগ করেন, পশ্চিমবঙ্গে ১৩ লক্ষ ৩ হাজার ৬৫ জনের নাম ভোটার তালিকায় দুই বা তার বেশি জায়গায় রয়েছে। তিনি দাবি করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার অনুগত অফিসারদের দিয়ে এই কাজ করিয়েছেন। অন্যদিকে, তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “নির্বাচন কমিশন বিজেপির আরেকটি ঘর।”
কংগ্রেস ও বামেদের অবস্থান
পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতা অধীর রঞ্জন চৌধুরী দাবি করেন, “পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৩৪ থেকে ৪০ লক্ষ ভুয়া ভোটার রয়েছে।” তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে কংগ্রেস দীর্ঘদিন ধরে সোচ্চার।
সিপিএম নেতা শমীক লাহিড়ী বলেছেন, “তৃণমূল ও বিজেপি মিলে ভুয়া ভোটার তৈরি করছে ভোটে জেতার জন্য। রাজ্যের প্রশাসনকে ব্যবহার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কত ভুয়া ভোটারের নাম ঢুকিয়েছেন, তার ঠিক নেই।”
বাংলাদেশি ভোটদাতার নাম নিয়ে বিতর্ক
ভুয়া ভোটার নিয়ে বিতর্কের মধ্যে পূর্ব বর্ধমানের কাটোয়া থেকে বাংলাদেশি ভোটদাতার নাম সামনে এসেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ভোটার তালিকায় এমন কিছু নাম রয়েছে, যারা বাংলাদেশে থাকেন এবং সেখানকার ভোটার।
সব দলের একমত: ভুয়া ভোটার আছে
পশ্চিমবঙ্গের সব রাজনৈতিক দলই একমত যে, ভোটার তালিকায় ভুয়া ভোটার রয়েছে। বিজেপি বলছে ১৩ লক্ষ, কংগ্রেস বলছে ৪০ লক্ষ, এমনকী তৃণমূল ও সিপিএমও বলছে ভুয়া ভোটার আছে। প্রশ্ন হলো, এই ভুয়া ভোটার কার সুবিধা করে দিচ্ছে?
প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেছেন, “ভোটার তালিকায় ভুলভাল থাকাটা সাধারণ ঘটনা। কিন্তু এবার ভুয়া ভোটার নিয়ে বিতর্ক অন্যবারের তুলনায় অনেক বেশি আলোচিত হচ্ছে। সম্ভবত নির্বাচন কমিশনের উপর চাপ তৈরি করতে চাইছে তৃণমূল।”
উপসংহার
পশ্চিমবঙ্গে ভুয়া ভোটার নিয়ে এই বিতর্ক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছ্বতা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে। রাজনৈতিক দলগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। আগামী দিনে এই ইস্যুটি রাজ্যের রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলে, তা দেখার বিষয়।