নব্বইয়ের দশকে ‘করণ অর্জুন’, ‘ঘাতক’, ‘তিরঙ্গা’র মতো বহু হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছেন মমতা কুলকার্নি। ইন্ডাস্ট্রিতে একের পর এক ব্লকবাস্টার ছবি উপহার দিয়ে জনপ্রিয় হয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারে সাফল্যের সিঁড়ি চড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিতর্কের সঙ্গেও তার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ে।
১৯৭২ সালে মুম্বইয়ে একটি মরাঠি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম মমতার। তার বাবা মহারাষ্ট্র পুলিশে কাজ করতেন। মমতার মা ছিলেন গৃহবধূ। বাবা-মা ও দুই বোনকে নিয়ে মুম্বাইয়ে থাকতেন মমতা।
অভিনয় জগতে মমতার আগ্রহ জন্মায় তার মায়ের কারণে। ছোট থেকেই অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলেন তার মা। কিন্তু স্বপ্নপূরণ না করতে পারায় নিজের মেয়ের চোখ দিয়েই সেই স্বপ্ন দেখতে চেয়েছিলেন তিনি। মায়ের স্বপ্ন বাস্তব করতে মডেলিং পেশায় নামেন মমতা।
সুন্দরী হওয়ায় মডেলিংজগতে খুব তাড়াতাড়ি নামডাক হয়ে যায় মমতার। সেই সূত্রে ১৯৯১ সালে ‘নানবারগাল’ নামে একটি তামিল সিনেমায় প্রথম অভিনয় করেন তিনি। ওই সিনেমা হিট হওয়ার এক বছর পর ‘মেরা দিল তেরে লিয়ে’ ও ‘তিরঙ্গা’ সিনেমায় অভিনয়ের প্রস্তাব পান মমতা।
তারপর মমতাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক হিন্দি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। কখনো শুধুমাত্র নাচের দৃশ্যে, কখনো বা নায়কের প্রেমিকার চরিত্রে আবার কখনো মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি।
হিন্দি ছাড়াও তামিল, তেলুগু, মালয়ালম ও কন্নড় ভাষার সিনেমায় কাজ করেছেন মমতা। মিঠুন চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘ভাগ্য দেবতা’ নামের একটি বাংলা সিনেমাতেও অতিথি শিল্পী হিসাবে দেখা গেছে তাকে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতেন মমতা।
কানাঘুষো শোনা যায় যে, এক রাজনৈতিক নেতার আমন্ত্রণে রাচিতে অনুষ্ঠান করতে গিয়েছিলেন মমতা। সেখানে অনুষ্ঠানে করে সওয়া এক কোটি টাকা পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন তিনি। কোনো হিন্দি সিনেমায় কাজ করেও সেই সময় বলিউড অভিনেতারা এত পারিশ্রমিক পেতেন না। পরে নাকি ওই নেতার সঙ্গে পটনায় কিছুটা সময় কাটিয়েছিলেন মমতা।
সাফল্যের সিঁড়িতে তড়তড়িয়ে ওঠার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠেছিল মমতার। তিনি ভেবেছিলেন যে, তার কোনো সাহসী ছবি প্রকাশ পেলে ইন্ডাস্ট্রিতে চাহিদা বেড়ে যাবে। তাই সেই সময়ের এক নামী পত্রিকার প্রচ্ছদের জন্য নিজের একটি সাহসী ছবি তুলেছিলেন মমতা।
মমতার সাহসী ছবিটি পত্রিকায় প্রকাশ পাওয়ার পর অভিনেত্রীর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন বলিপাড়ার অধিকাংশ। তার উদ্দেশে কুমন্তব্যও করেন অনেকে। পরিস্থিতি বুঝে ক্ষমা চান মমতা। এমনকি আদালতে ১৬ হাজার টাকা জরিমানাও দেন তিনি।
কটাক্ষের শিকার হলেও মমতার ছবি প্রকাশ পাওয়ায় পত্রিকাটি বেশি দামে বিক্রি হতে থাকে। অভিনেত্রী জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়ায় সবাই তাকে ক্ষমাও করে দেন। ইন্ডাস্ট্রিতে আবার চুটিয়ে কাজ করতে থাকেন তিনি।
১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় ‘চায়না গেট’। সিনেমার শুটিং চলাকালীন পরিচালক রাজকুমার সন্তোষীর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনেন মমতা। কিন্তু পরিচালক সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। রাজকুমারের দাবি ছিল, মমতা এসব বানিয়ে বানিয়ে বলেছেন। সকলে রাজকুমারের কথাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু এই ঘটনার পর ইন্ডাস্ট্রিতে মমতা সম্পর্কে ধারণা বদলে যায়।
‘চায়না গেট’ সিনেমা মুক্তি পাওয়ার পর মমতা দাবি করেন, তার অভিনীত অনেক দৃশ্য বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সিনেমায় যেন বেশি গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছে ঊর্মিলা মাতন্ডকরের ‘ছম্মা ছম্মা’ নাচটি। তাই এই সিনেমা মুক্তির পর মমতার চেয়ে ঊর্মিলার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
‘চায়না গেট’ সিনেমার পর ইন্ডাস্ট্রিতে মমতার চাহিদাও কমে যেতে থাকে। এই ছবির শুটিংয়ের সময় অ্যাকশন ডিরেক্টর তিনু বর্মার সঙ্গে মমতার আলাপ হয়। তিনু তখন বিবাহিত ছিলেন, দুই সন্তানের বাবাও। তিনুর সঙ্গে মমতার বন্ধুত্ব গভীর হতে থাকে।
বলিপাড়ার অধিকাংশের দাবি, তিনু ও মমতা গোপনে বিয়েও করে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাদের সম্পর্কে হঠাৎ চির ধরে। নিত্য অশান্তি হতো দু’জনের। তিনুর স্ত্রী তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে মমতার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হয় তিনুর।
যদিও তিনুর সঙ্গে সম্পর্কের কথা স্বীকার করেননি মমতা। কিন্তু তিনু এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, মমতার জন্য তিনি নিজের স্ত্রীকে ছেড়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভুল করেছিলেন।
২০০২ সালে ‘কভি তুম কভি হম’ সিনেমায় শেষবারের মতো অভিনয় করতে দেখা যায় মমতাকে। তারপর ইন্ডাস্ট্রি থেকে একেবারে উধাও হয়ে যান তিনি। চারবছর পর মমতার নাম উঠে আসে মাদক পাচারকাণ্ডে। ভিকি গোস্বামী নামে এক মাদক পাচারকারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।
দু’হাজার কোটি টাকার মাদক পাচারকাণ্ডের তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, এই পরিকল্পনার সময় মমতাকে অন্যান্য অভিযুক্তদের সঙ্গে একই হোটেলে দেখা গিয়েছিল। মমতার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হলে তিনি জানান যে, তাকে অকারণে ফাঁসানো হচ্ছে। এমনকি ভিকির সঙ্গে সম্পর্কের কথাও অস্বীকার করেন তিনি।
এরপর মুম্বাই ছেড়ে ভিকি ও মমতা দু’জনেই দুবাই চলে যান। ভিকি পাঁচ বছরের হেফাজতে থাকার শাস্তি পান। জেল থেকে ফিরে এলে মমতাকে নিয়ে কেনিয়ায় চলে যান ভিকি। শোনা যায় যে, ২০১৩ সালে দু’জনে বিয়ে করেন। যদিও বিয়ের কথা কখনও স্বীকার করেননি মমতা।
২০২২ সালে আবার ক্যামেরার সামনে আসেন মমতা। কিন্তু বড় বা ছোট পর্দা নয়, ফোনের ক্যামেরার সামনে এসে একটি ভিডিও পোস্ট করেছিলেন তিনি। এই ভিডিওটি নেটে ছড়িয়ে পড়ায় আবার তাকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়।
সন্ন্যাসিনীর বেশে দেখা যায় মমতাকে। তিনি জানান যে, মাদক পাচারের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না। ভিকিকেও তিনি বিয়ে করেননি। তারা দু’জন কেবল ভালো বন্ধু ছিলেন। সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে তিনি এখন ধ্যানজ্ঞানে মন দিয়েছেন বলেও দাবি করেন মমতা।
মমতা বলেন, ১২ বছর ধরে ধ্যান করছি আমি। এখন আমার সামনে কোনো পুরুষ নগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেও আমার কিছু যায় আসে না। আমি অন্তর থেকে পবিত্র হয়ে গিয়েছি।’ মমতা একটি বই লিখেছেন বলেও জানিয়েছিলেন ভিডিওতে। এই ভিডিওর পর তিনি আবার নিরুদ্দেশ হয়ে যান।
মমতা এখন কী করছেন, কোথায় রয়েছেন সে বিষয়ে কারো ধারণা নেই। তবে একাংশের দাবি, ভিকির সঙ্গে কেনিয়াতেই রয়েছেন তিনি। আবার অনেকের ধারণা, সন্ন্যাস গ্রহণ করে নিজের মতো জীবন কাটাচ্ছেন মমতা।