ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা: ১৯৫০ সালেই দুর্নীতির আঁচ করেছিলেন সর্দার প্যাটেল, নেহরুকে দিয়েছিলেন সতর্কবার্তা

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কৌশলে চাপা পড়ে যাওয়া ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা অবশেষে ফের আলোচনার কেন্দ্রে। গান্ধী পরিবারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই মামলা নিয়ে কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে এখন জোর চর্চা। ইডির অভিযোগ, ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি হস্তান্তরে আর্থিক তছরুপের মূল কারিগর ছিলেন কংগ্রেসের সোনিয়া গান্ধী ও রাহুল গান্ধী। স্বাভাবিকভাবেই, কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে বিজেপি।

তবে এই ন্যাশনাল হেরাল্ড দুর্নীতির শিকড়ের সন্ধানে পিছিয়ে যেতে হবে সুদূর ১৯৫০ সালে। সেসময়ই দুর্নীতির আঁচ করে সতর্কবাণী দিয়েছিলেন ভারতের লৌহমানব সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। রাজনৈতিক দলের অনুদান সংগ্রহের জন্য ন্যাশনাল হেরাল্ড সংবাদপত্রকে কাজে লাগানো হচ্ছে বলে আগেই সতর্ক করেছিলেন প্যাটেল। ১৯৫০ সালে তাঁর লেখা একাধিক চিঠিতে এর উল্লেখ রয়েছে, যা পরে ‘সর্দার প্যাটেলস করেসপন্ডেন্স’ নামক বইতেও লিপিবদ্ধ হয়েছে।

প্রকাশ্যেই জওহরলাল নেহরুকে সতর্ক করেছিলেন প্যাটেল। সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বেআইনি পথে আসা অনুদান এড়িয়ে যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। যদিও প্যাটেলের সতর্কবাণী নেহরু কর্ণপাত করেননি। বরং নেহরুর উদাসীনতা ও তদন্তের শুকনো প্রতিশ্রুতি প্যাটেলের করা ভবিষ্যদ্বাণীকে আরও জোরালো করে তুলেছিল। আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে প্যাটেলের অভিযোগকে উপেক্ষা করে ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিল কংগ্রেস। আর সেই উন্নাসিকতাই দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে বড়সড় দুর্নীতির জন্ম দিয়েছে বলে অভিযোগ বিজেপির।

বর্তমানে ন্যাশনাল হেরাল্ডের প্রকাশনা বন্ধ। কিন্তু ওই সংবাদপত্রের সম্পত্তি আত্মসাৎ করতে ইয়ং ইন্ডিয়ান লিমিটেড সংস্থার মাধ্যমে সোনিয়া ও রাহুল গান্ধী নানা বেআইনি কার্যকলাপ ও অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে ইডির চার্জশিটে স্পষ্টতই উল্লেখ করা হয়েছে, উক্ত মামলা শুধু আর্থিক তছরুপ সংক্রান্তই নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ব্যক্তিগত সম্পত্তি হাতানোর অপচেষ্টা নিয়েও।

১৯৫০ সালে ভারতীয় বায়ুসেনার আপত্তি সত্ত্বেও হিমালয়ান এয়ারওয়েজ নামে এক উড়ান সংস্থাকে সরকারি কন্ট্রাক্ট পাইয়ে দেওয়া হয়েছিল। ওই উড়ান সংস্থার আধিকারিকদের তরফে আবার ন্যাশনাল হেরাল্ডকে ৭৫ হাজার টাকা অনুদান বাবদ দেওয়া হয়। এভাবে বাঁকা পথে আসা অনুদান নিয়েই নেহরুকে ৫ মে চিঠিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন বল্লভভাই প্যাটেল। বিশেষজ্ঞদের মতে, সে যুগে রাজনৈতিক স্বজনপোষণের অন্যতম উদাহরণ ওই ঘটনা।

প্যাটেল এখানেই থেমে থাকেননি। প্রকাশ্যে বিস্ফোরক অভিযোগ করেছিলেন তিনি। অনুদান প্রদানকারী হিমালয়ান এয়ারওয়েজের ওই আধিকারিকদের মধ্যে আখানি নামে একজন ব্যাঙ্ক প্রতারণার মামলায় অভিযুক্ত বলেও বোমা ফাটিয়েছিলেন প্যাটেল। শুধু তাই নয়, জেপি শ্রীবাস্তবের মতো লখনউয়ের বিতর্কিত ব্যবসায়ীদের থেকেও পত্রের বিনিময়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আহমেদ কিড়ওয়াই অনুদানে অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ। যদিও আগের মতোই এবারেও কড়া কোনও সাড়া মেলেনি নেহরুর তরফে। হেরাল্ডের তৎকালীন জেনারেল ম্যানেজার তথা নেহরুর জামাই ফিরোজ গান্ধীকে বিষয়টি দেখার কথা বলেন জওহরলাল নেহরু। বিশেষজ্ঞদের দাবি, নেহরুর এহেন আচরণ উদাসীনতার পরিচয় ছাড়া আর কিছুই নয়।

অনড় বল্লভভাই প্যাটেল ৬ মে চিঠিতে নেহরুকে স্পষ্ট জানান, বেশকিছু অনুদান বেসরকারি নানা কোম্পানি মারফত এসেছে, যেগুলি আদৌও সেবামূলক কোনও উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে বলে কিছুই উল্লেখ নেই। এবারও নেহরু ভিত্তিহীন একপ্রকার ব্যাখ্যা দেন। তাঁর দাবি ছিল, ৩ বছর ধরে ওই অনুদান সম্পর্কিত কিছুতে তিনি জড়িত ছিলেন না। মৃদুলা নামে কোনও একজনকে ওই বিষয়টি দেখার ভার সঁপে দিয়েছিলেন নেহরু। কিছু ভুলভ্রান্তি হলেও হয়ে থাকতে পারে, এমনটা স্বীকার করেও নেহরুর সাফাই ছিল, গোটাটাই ব্যবসায়িক লাভ ও লোকসানের ব্যাপার। এতে জবাবদিহির কোনও জায়গাই নেই।

ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলার আবেদনকারী তথা বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামী অবশ্য বারংবারই প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কথা বলে এসেছেন। গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে জনগণের সম্পত্তি আত্মসাতের অভিযোগ করেছেন তিনি। তাতে বিজেপির করা অভিযোগগুলিও যেন বাড়তি অক্সিজেন পেয়েছে। কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধিতে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ গেরুয়া শিবিরের। ঐতিহাসিক নানা তথ্যপ্রমাণ ও ইডির উদ্ধার করা বিভিন্ন সূত্রের কাছে কংগ্রেসের আত্মপক্ষ সমর্থনের যুক্তিও কার্যত ফিকে হয়ে গিয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। বর্তমান সময়ে কংগ্রেসের মধ্যে নীতিপঙ্গুত্ব কাজ করছে বলে দাবি গেরুয়া শিবিরের। শুধু তাই নয়, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা আর্থিক দুর্নীতির পাশাপাশি বড়সড় প্রাতিষ্ঠানিক দুরবস্থারও পর্দাফাঁস করে দিয়েছে বলে দাবি বিজেপির। কংগ্রেসের নেতৃত্বরা আধুনিক ভারতের রূপকারদের অবজ্ঞা করেছে বলেও অভিযোগ বিজেপির। প্যাটেলের সতর্কবাণীর কথা উল্লেখ করে বিজেপির দাবি, নিজেদের পরিবারতন্ত্রের উপর অগাধ আস্থা রেখে ভারতের স্বার্থে আঘাত করেছে কংগ্রেস।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ন্যাশনাল হেরাল্ড মামলা নিছকই আইনি যুদ্ধের পরাকাষ্ঠা নয়, বরং যেকোনও রাজনৈতিক দলের কাছে যে ব্যক্তিগত স্বার্থের চেয়েও দেশের স্বার্থ বড়, সেই ধ্রুব সত্যটি শিখিয়ে দিল।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy