ধর্মের বিভাজন মিড-ডে মিলেও! একই স্কুলে দু’হাঁড়িতে রান্না, হতবাক প্রশাসন, তদন্তে কমিটি

একই ক্লাসে পাশাপাশি বসে পড়াশোনা, একই টেবিলে বসে টিফিন – অথচ মিড-ডে মিলের খাবার আসে দু’টি ভিন্ন হাঁড়ি থেকে! যার যার ধর্ম অনুযায়ী বরাদ্দ হাঁড়ি থেকেই খাবার পায় পড়ুয়ারা। পূর্ব বর্ধমানের কালনার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমন আজব এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর রাজ্যজুড়ে তুমুল হইচই শুরু হয়েছে।

দীর্ঘদিনের প্রথা, অজানা কারণ:

কালনা মহকুমার নাদনঘাট থানা এলাকার নসরতপুরের কিশোরীগঞ্জ মনমোহনপুর অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এই পদ্ধতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় গ্রামবাসীরা। কিন্তু কেন এমন আজব নিয়মে মিড-ডে মিল রান্না করা হয়, তার কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই কারও কাছে। এই অদ্ভুত ব্যবস্থায় স্কুলের খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে সমস্যায় পড়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাপস ঘোষ জানান, “এমনিতে স্কুলে কোনও সমস্যা নেই, ধর্ম নিয়ে কোনও গন্ডগোলও নেই। অথচ স্কুলে দুই ধর্মের জন্য দু’রকম রান্না করা হয়। প্রথম থেকেই আমি এটা দেখে আসছি। কিন্তু সমস্যা মেটাতে পারিনি। এর জন্য আমার খরচ বাড়ছে। তাই আমি চাই স্কুলের সকল ছাত্রছাত্রীদের জন্য এক ধরনের খাবারই রান্না করা হোক।”

স্থানীয়দের মিশ্র প্রতিক্রিয়া:

স্থানীয় বাসিন্দা অমিত হাজারি বলেন, “আমাদের এখানে দীর্ঘদিন ধরে দু’পক্ষের জন্য আলাদা করে রান্না করা হয়। উভয়পক্ষের সম্মতিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।” এক অভিভাবক পরিমল মণ্ডল এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করে বলেন, “অনেকদিন ধরেই এটা চলছে। রান্না করার লোকও আলাদা। এই ব্যবস্থা থাকলেই ভালো হয়।” তবে গ্রামের বাসিন্দা গণেশ গোঁসাই বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “স্কুলের মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে ছাত্রছাত্রীদের দুই ধরনের মিড ডে মিলের খাবার দেওয়া হয়। কিন্তু কী কারণে এটা হয়েছে সেটা জানি না।”

স্কুলের রাঁধুনি ভানু বিবি, যিনি দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এই স্কুলে রান্না করে আসছেন, তিনি বলেন, “দুটো ভাগে রান্না হয়। দুই ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের জন্য আলাদা আলাদা খাবার বাচ্চাদের দেওয়া হয়। খারাপও লাগে বাচ্চাদের জন্য। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ যেটা করতে বলে আমরা সেটাই করে থাকি।”

প্রশাসনিক পদক্ষেপ:

বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষক তাপস ঘোষ প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে জানিয়েছেন এবং তিনি চান যে রান্নার ব্যবস্থা একসঙ্গে হোক। স্থানীয় তৃণমূল নেতা আমেদ আলি শেখ এই ঘটনাকে ‘লজ্জাজনক’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “পড়াশোনা একসঙ্গে হয়, রান্না আলাদা ভাবে হয়, খাওয়া হয় একসঙ্গে।”

প্রশাসনের অধিকাংশ আধিকারিকই এই বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ হলেও, পূর্ব বর্ধমানের ডিস্ট্রিক্ট প্রজেক্ট অফিসার মিড ডে মিল পৌষালী চক্রবর্তী বলেন, “বিষয়টি দেখা হচ্ছে।” প্রশাসনের সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, জেলা প্রশাসন এবং স্কুল শিক্ষা দফতরের আধিকারিকেরা এই বিষয়ে কথা বলেছেন। স্কুলের মিড-ডে মিলের রান্নার জন্য কেন দুটি ভিন্ন ব্যবস্থা, এবং কেন আলাদা আলাদা রাঁধুনি রাখা হয়েছে – এসব জানতে চেয়েছে স্কুল শিক্ষা দফতর। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে জয়েন্ট বিডিওর নেতৃত্বে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এই কমিটিই আগামীদিনে ওই স্কুলে রান্নার ব্যবস্থা কী হবে, তা নির্ধারণ করবে।

শিক্ষাঙ্গনে এমন ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টির ঘটনা একবিংশ শতাব্দীতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছে শিক্ষাবিদ মহল। প্রশাসন কী পদক্ষেপ করে এবং এই অদ্ভুত প্রথার অবসান ঘটে কিনা, এখন সেটাই দেখার।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy