
পশ্চিমবঙ্গের রথযাত্রা উৎসব এ বছর ধর্মীয় আবহের পাশাপাশি এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা পেয়েছে, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দিঘার নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দির এবং শাসক-বিরোধী শিবিরের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে দিঘায় রথযাত্রার আয়োজনে যখন ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে, এমনকি মন্দিরের বিশেষ প্রসাদ, গজা-পেঁড়া, বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেওয়া শুরু হয়েছে, তখনই পাল্টা চাল দিলেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর দাবি, এবার পুরীর মহাপ্রসাদও বাংলায় বিলি হবে, যা রথযাত্রা ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনাকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে।
দিঘা রথযাত্রার সূচনা ও মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি:
এই প্রথম দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে রথযাত্রা উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে, যা ইতিমধ্যেই রাজ্যের সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইতিমধ্যেই দিঘা পৌঁছে গেছেন এবং সরকারের পক্ষ থেকে এই উৎসবকে সফল করতে ব্যাপক তৎপরতা চালানো হচ্ছে। দিঘার প্রসাদ বিলি শাসক দলের এক বড় জনসংযোগ উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে, যা মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
শুভেন্দুর ‘মহাপ্রসাদ’ বোমা:
ঠিক এই পরিস্থিতিতেই শুভেন্দু অধিকারী এক বিস্ফোরক দাবি করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের সামনে বলেন, “পুরী থেকে মহাপ্রসাদ আসছে। তমলুকের গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মন্দির থেকে সেটা বিলি করা হবে। পাঁচ দিন ধরে পুরীর মহাপ্রসাদ বিলি হবে।” তিনি আরও জানান, ২৭শে জুন, রথযাত্রা দিবসে কলকাতার চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউতে দুপুর ৩টের সময় পুরী থেকে এই মহাপ্রসাদ এসে পৌঁছাবে। শুভেন্দুর মতে, এদিন দুপুর ১২টা নাগাদ কলকাতার রথযাত্রা শুরু হবে এবং বিকেল ৪টের সময় ইস্কন-মেচেদার রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হবে।
শুভেন্দুর এই মন্তব্য দিঘার প্রসাদ বিলির সঙ্গে সরাসরি এক পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। ধর্মীয় উৎসবের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানোর এই প্রচেষ্টায় এখন শাসক ও বিরোধী উভয় শিবিরই নিজেদের প্রভাব বিস্তারে মরিয়া।
রথযাত্রা: রাজনীতির নতুন মঞ্চ:
রথযাত্রা উৎসব এখন কেবল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হয়ে উঠেছে। দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের রথযাত্রা উৎসবকে তৃণমূল তাদের সাফল্য ও জনপ্রিয়তার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরছে। অন্যদিকে, শুভেন্দু অধিকারী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন, “দিঘায় রথযাত্রায় ভিড় উপচে পড়বে, কিন্তু কলকাতায় সিআর অ্যাভিনিউতে যে রথযাত্রা হবে, সেখানে দিঘার চেয়ে অনেক বেশি লোক আসবে।” তিনি বিজেপির কলকাতা রথযাত্রাকে আরও বৃহৎ ও প্রভাবশালী করার আশ্বাস দিয়েছেন।
প্রসাদ বিলি ও রাজনৈতিক বার্তা:
প্রসাদ বিলির বিষয়টি এখন কেবল ধর্মীয় আদান-প্রদান নয়, বরং একটি কৌশলগত রাজনৈতিক পদক্ষেপও বটে। তৃণমূল সরকারের দিঘায় গজা-পেঁড়া বিলি স্থানীয় মানুষের মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর একটি প্রচেষ্টা। এর বিপরীতে শুভেন্দু অধিকারী পাল্টা কটাক্ষ করে বলছেন যে, “পুরী থেকে মহাপ্রসাদ আসছে, এবং এটি বিজেপির নেতৃত্বাধীন এলাকার মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হবে।” তিনি আরও স্পষ্ট করেন যে, “বিজেপি বিশ্বাস করে, মানুষের জন্য কাজ করতে হবে, আর পুরীর মহাপ্রসাদ বাংলার প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছানো হবে।” তাঁর এই মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, বিজেপির উদ্যোগগুলি নিছকই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ, কোনও রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব থাকবে না।
সামগ্রিকভাবে, রথযাত্রার রাজনৈতিক গুরুত্ব এবার আরও স্পষ্ট। এই উৎসবের মাধ্যমে উভয় দলই নিজেদের প্রভাব ও জনপ্রিয়তা সুদৃঢ় করতে চাইছে। দিঘার রথযাত্রা তৃণমূলের জন্য একটি বড় রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম, আর বিজেপির কাছে কলকাতার রথযাত্রা একটি বড় আন্দোলন। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে রথযাত্রার প্রস্তুতি তুঙ্গে, এবং এই উৎসব ও মহাপ্রসাদ বিলিকে কেন্দ্র করে রাজ্যের রাজনীতিতে এক নতুন মোড় আসার সম্ভাবনা প্রবল। শাসক-বিরোধী তর্ক-বিতর্ক নিঃসন্দেহে আরও তীব্র হবে।