জমি বিক্রি করে ছেলের পড়াশোনার খরচা চালিয়েছেন বাবা! NEET-এ তাক লাগল অনিক, খুশি পরিবার

পরিবারে একজন ডাক্তার দেখার স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করতে অমানুষিক পরিশ্রম আর আত্মত্যাগ করেছেন মুর্শিদাবাদের কৃষক তুষারকান্তি ঘোষ। ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগাতে নিজের জমি পর্যন্ত বিক্রি করতে পিছপা হননি তিনি। অবশেষে তার সেই সমস্ত কষ্ট সার্থক হলো। সর্বভারতীয় মেডিক্যাল প্রবেশিকা (NEET) পরীক্ষায় ৬৭ র‍্যাঙ্ক করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন ছেলে অনিক ঘোষ। তবে এই সাফল্যের পেছনে কিছুটা বিষাদের সুরও আছে, কারণ অনিকের দাদু এই স্বপ্ন পূরণ দেখে যেতে পারলেন না।

মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘি এলাকার বাসিন্দা অনিক ঘোষ পড়াশোনার জন্য দুর্গাপুরে থাকতেন। সেখানে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল থেকে দশম এবং দ্বাদশ শ্রেণিতেও তার ফল ছিল নজরকাড়া। এবার সর্বভারতীয় ডাক্তারি পরীক্ষাতেও তিনি ৬৭ র‍্যাঙ্ক অর্জন করেছেন, যা তার কঠোর পরিশ্রমের ফসল। অনিক তাদের পরিবারের প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত সদস্য। তার বাবা কৃষক এবং মা গৃহবধূ। দারিদ্র্য সত্ত্বেও, বাবা-মা সন্তানকে কখনও তা বুঝতে দেননি। তুষারকান্তি ছেলেকে দুর্গাপুরে রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন। প্রথমে আইসিএসসি বোর্ড, তারপর একাদশ-দ্বাদশে সিবিএসসি বোর্ডে অনিক পড়াশোনা করেন।

অনিকের কথায়, “বাবা আমাকে একাদশ-দ্বাদশে পড়ানোর জন্য অর্ধেক জমি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। আজ আমি বাবার সেই আত্মত্যাগের উপহার দিলাম। আমার বাবা-মা আজ খুব খুশি।” নিজের মোবাইল আসক্তির কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, “আমার মোবাইল দেখতে খুব ভালো লাগে। আমার মোবাইল দেখার সময়টা পড়াশোনা করার থেকেও বেশি ছিল।” কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, তিনি দিনে মোটামুটি চার-পাঁচ ঘণ্টা পড়তেন এবং একাদশ শ্রেণি থেকেই নিটের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিলেন।

মানুষের শরীর কিভাবে কাজ করে, এই নিয়ে ছোটবেলা থেকেই অনিকের কৌতূহল ছিল। আর এই কৌতূহলই তাকে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল। তার কথায়, “আমি ছোট থেকেই ভাবতাম একটা মানুষের শরীরে এমন কী কী রয়েছে যার কারণে তার শরীর কাজ করছে?” পরে তিনি জানতে পারেন যে তার দাদুরও ইচ্ছে ছিল পরিবারের কেউ একজন ডাক্তার হোক। “এমনকি, শেষ জীবনে তিনি বিনা চিকিৎসায় মারা যান। যদিও আমি দাদুকে দেখিনি। পুরো গল্পটাই শুনেছি বাবার মুখে। তাই ছোট থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখি,” যোগ করেন অনিক।

দিল্লি এইমসের স্বপ্ন ও সামাজিক দায়বদ্ধতা
অনিক এখন নিজেকে দিল্লি এইমসে (AIIMS) ভর্তির জন্য প্রস্তুত করছেন। তার মতে, “আমার রাজ্যে অনেক মেডিক্যাল কলেজ আছে ঠিকই। কিন্তু, এত কষ্ট করে পড়াশোনা করলাম, এত ভালো ফলাফল করলাম। আমার কাছে সুযোগ আছে সব থেকে ভালোটা পাওয়ার। তাহলে কেন যাব না!”

সম্প্রতি আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার প্রতিবাদে অনিক পথে নেমেছিলেন। তার মতে, “এই আন্দোলন আরও দরকার ছিল। এই আন্দোলন শুধু ছিল ডাক্তারদের। কিছুদিন সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমেছেন। তারপর আর প্রতিবাদ করেননি। এটা ভুল। মানুষকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। রাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষাগত সবদিক থেকে মানুষকে আরও শিক্ষিত হতে হবে। তবেই আমাদের সমাজে আর এই ধরনের ঘটনা ঘটবে না। এই আন্দোলন শুধু ডাক্তারদের নয়, এই আন্দোলন প্রতিটা মানুষের হওয়া দরকার ছিল।”

অনিকের এই সাফল্য কেবল তার পরিবারের স্বপ্নপূরণ নয়, বরং সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতা এবং সচেতন চিন্তাভাবনারও প্রতিফলন। তার এই যাত্রা নিঃসন্দেহে আগামী প্রজন্মের কাছে এক দারুণ অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy