“চুক্তির সময়েই জানি, পাব না”-দেশীয় অস্ত্র উৎপাদন ও বিলম্ব নিয়ে ক্ষোভ বায়ুসেনা প্রধানের

সম্প্রতি সফল হওয়া ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ আকাশ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, আকাশতীর এয়ার ডিফেন্স অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম, এবং ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ভারতের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও, তাদের সময় মতো সরবরাহ না হওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতীয় বায়ুসেনা প্রধান, এয়ার চিফ মার্শাল অমর প্রীত সিং। বৃহস্পতিবার এক সরকারি অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর উপস্থিতিতেই তিনি এই উদ্বেগ তুলে ধরেন।

“চুক্তির সময়েই জানি, পাব না” – ক্ষোভ উগরে দিলেন বায়ুসেনা প্রধান

এয়ার চিফ মার্শাল সিং বলেন, “অনেক সময়, চুক্তি স্বাক্ষর করার সময়ই আমরা বুঝতে পারি, সিস্টেমগুলি কখনই সময়ে আসবে না। সময়সীমা রক্ষা না করা আমাদের একটা বড় সমস্যা। একটি প্রকল্পও সময় মতো সম্পন্ন হয়েছে বলে আমি মনে করতে পারছি না। কেন আমরা এমন কিছু প্রতিশ্রুতি দেব যা আমাদের পক্ষে রক্ষা করা সম্ভব নয়?” তাঁর এই সরাসরি মন্তব্য দেশের প্রতিরক্ষা উৎপাদন ব্যবস্থার দীর্ঘদিনের দুর্বলতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

৮৩টি যুদ্ধবিমানের একটিও মেলেনি:

প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পেতে দেরি হওয়ার একাধিক ঘটনা উল্লেখ করে এয়ার মার্শাল অমর প্রীত সিং জানান, ৮৩টি ‘এলসিএ তেজস এমকে১এ’ ফাইটার জেট কেনার জন্য ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড (হ্যাল)-এর সঙ্গে ৪৮,০০০ কোটি টাকার চুক্তি করা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ২০২৪ সালের মার্চে যুদ্ধবিমানগুলি সরবরাহ শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৮৩টি যুদ্ধবিমানের একটিও এখনও ভারতীয় বায়ুসেনা (আইএএফ) হাতে পায়নি বলে তিনি জানিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, “তেজস এমকে১-এর সরবরাহে দেরি হচ্ছে। তেজস এমকে২-এর প্রোটোটাইপ এখনও তৈরি হয়নি। স্টেলথ এএমসিএ ফাইটারের এখনও কোনও প্রোটোটাইপ তৈরি হয়নি।”

“প্রতিশ্রুতি দিলে, তা রক্ষা করা উচিত”: আত্মনির্ভরতার পথে বাধা

বায়ুসেনা প্রধান জোর দিয়ে বলেন, “ভারতে শুধু উৎপাদন করলেই চলবে না, আমাদের নকশা তৈরিও করতে হবে। আমাদের বাহিনী এবং শিল্পজগতের মধ্যে আস্থা থাকা দরকার। একবার কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে, তা রক্ষা করা উচিত।” তিনি জানান, বায়ুসেনা ভারতে উৎপাদনকে উৎসাহিত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এবং আগামী ১০ বছরে ভারতের দেশীয় শিল্প জগৎ থেকে আরও সামরিক সরঞ্জাম প্রয়োজন হবে বায়ুসেনার। তবে, আজকের প্রয়োজন আজই মেটানো উচিত, ১০ বছর বাদে নয়। তিনি যোগ করেন, “বাহিনীকে ক্ষমতায়িত করতে পারলে তবেই যুদ্ধে জেতা যায়।”

দ্রুত বদলাচ্ছে যুদ্ধ, তাল মেলাতে হবে:

ড্রোন প্রযুক্তির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধের প্রকৃতি বদলে গিয়েছে বলেও জানান বায়ুসেনা প্রধান। তাই সশস্ত্র বাহিনীতে নতুন প্রযুক্তির সময় মতো অন্তর্ভুক্তি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তিনি বলেন, “যুদ্ধের ধরন বদলে যাচ্ছে। প্রতিদিন আমরা নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব দেখতে পাচ্ছি। আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, ভবিষ্যতে আমাদের কী প্রয়োজন, সেই সম্পর্কে অপারেশন সিঁদুর আমাদের স্পষ্ট ধারণা দিয়েছে। তাই আমাদের নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে। অনেক কাজ করা দরকার।”

বায়ুসেনা প্রধানের প্রথম ‘বিস্ফোরণ’ নয়:

ভারতের দেশীয় প্রতিরক্ষা উৎপাদনে দেরি নিয়ে বায়ুসেনা প্রধানের প্রকাশ্য সমালোচনা এই প্রথম নয়। ২০২৪ সালের অক্টোবরে বায়ুসেনা প্রধানের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি এই বিষয়ে সরব। সে সময় তিনি বলেছিলেন, এক সময় সামরিক প্রযুক্তিতে চীনের থেকে এগিয়ে ছিল ভারত, কিন্তু তারপর থেকে ক্রমে পিছিয়ে পড়েছে। তিনি বলেছিলেন, “উৎপাদনের হারে আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে।” চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতেও তিনি হ্যাল-এর প্রকাশ্যেই সমালোচনা করে বলেছিলেন, হ্যাল নিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস নেই, কারণ ফেব্রুয়ারিতে ১১টি তেজস এমকে১এ তৈরি থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও একটিও তৈরি হয়নি। তিনি তখন মন্তব্য করেছিলেন, হ্যাল ‘মিশন মোড’-এ নেই।

এয়ার চিফ মার্শাল অমর প্রীত সিং-এর এই ধারাবাহিক উদ্বেগ প্রতিরক্ষা উৎপাদন খাতের জন্য একটি কঠোর বার্তা, যা দেশের সামরিক প্রস্তুতি এবং ‘আত্মনির্ভর ভারত’ লক্ষ্য পূরণে সময়োপযোগী সরবরাহের গুরুত্বকে পুনর্বার তুলে ধরল।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy