
কালীগঞ্জে উপনির্বাচনের ফল প্রকাশের দিন বোমার আঘাতে ১৩ বছরের নাবালিকা তামান্না খাতুনের মর্মান্তিক মৃত্যু নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা বাংলাকে। এই ঘটনা সাত বছর আগের এক বিভীষিকাময় স্মৃতিকে নতুন করে উসকে দিয়েছে— হাড়োয়ার সেই বোমা বিস্ফোরণ, যেখানে ৮ বছরের ছোট্ট পৌলমী হালদারের হাত উড়ে গিয়েছিল। তামান্নার মতো তার পরিণতি অতটা ভয়াবহ না হলেও, সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতি আর শারীরিক যন্ত্রণার ক্ষত আজও দগদগে। তাই ভোটের আবহে নিরীহ প্রাণের বলিদান রুখতে করজোড়ে হিংসা বন্ধের করুণ আর্তি জানাচ্ছে এই কিশোরী।
ভোটের সহিংসতায় বারবার কেন শিশুরা বলি?
১৫ বছর বয়সী পৌলমী এখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। কালীগঞ্জের ঘটনা শুনে তার কণ্ঠে বিষণ্ণতা, “এরকম ঘটনা কেন বারবার ঘটছে তা প্রশাসনের দেখা উচিত। অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। আমরা বয়সে এখন যথেষ্ট ছোট। ভোটের বিষয়ে কিছুই জানি না। তা সত্ত্বেও কালীগঞ্জে ছোট্ট মেয়েটার জীবন চলে গেল! ভোটের সময় কেন বারবার শিশুদের টার্গেট করা হয় তা বুঝতে পারি না। আমার মতো ওই নাবালিকা মেয়েটাও ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল না। তার পরেও বোমার আঘাতে মরতে হল ওকে। এরকম ঘটনা আর কারোর সঙ্গে যেন না-ঘটে। ভোটে হিংসা বন্ধ হোক। প্রত্যেকেই আমরা মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করতে পারি, সেটাই চাই।”
পৌলমীর বিভীষিকাময় অতীত:
২০১৮ সালের ২০শে এপ্রিল, উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়ার গোপালপুর গ্রামে আট বছরের পৌলমী ঠাকুরমার সঙ্গে ভোরবেলায় ফুল তুলতে গিয়েছিল। তখন সে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী। ফুলগাছের তলায় সে গোলাকার একটি বস্তু দেখতে পায় এবং বল ভেবে সেটি ঘরে নিয়ে আসে। পরিচিত এক দাদু সেটি দেখেই বোমা সন্দেহ করেন। ভয়ে তড়িঘড়ি সেটি ছুঁড়ে দিতেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ। বিস্ফোরণে ছোট্ট পৌলমীর বাঁ-হাতের কব্জি উড়ে যায়। রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়ে সে। জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করে। সেই ঘটনা ঘিরে রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয়। রাজনৈতিক নেতাদের ভিড় বাড়ে, প্রতিশ্রুতির বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু এত কিছুর পরেও পৌলমী আর তার পরিবারের জীবন রয়ে গিয়েছে অন্ধকারে।
অপূর্ণ প্রতিশ্রুতি, নতুন কৃত্রিম হাতের প্রয়োজন:
সেই সময় প্রাক্তন বিধায়ক তথা ফুটবলার দীপেন্দু বিশ্বাস ছোট্ট পৌলমীকে একটি কৃত্রিম হাতের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই হাতের সাহায্যেই সে শৈশব কাটিয়েছে। কিন্তু কৈশোরে পা দিয়ে তার শারীরিক গঠনে পরিবর্তন হওয়ায় সেই কৃত্রিম হাত আর কাজে লাগে না। বর্তমানে নতুন কৃত্রিম হাত তৈরি করতে প্রায় ১৬ লক্ষ টাকা লাগবে। নুন আনতে পান্তা ফুরনোর সংসারে এই বিপুল টাকা কোথা থেকে আসবে, তা ভেবে কুলকিনারা পাচ্ছে না পৌলমীর পরিবার। তার বাবা শম্ভু হালদার একজন নার্ভের রোগী, ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারেন না। বাড়িতে মুরগি পালন করে কোনও মতে সংসার চলে তাঁদের।
শান্তির বার্তা, একটাই প্রার্থনা:
আর বছর ঘুরলেই আরও একটা বিধানসভা নির্বাচন। তাই ভোটের কথা শুনলেই এখন ভয় লাগে পৌলমী ও তার পরিবারের। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় দিনের কথা আজও তার চোখে-মুখে ভেসে ওঠে। অভিশপ্ত সেই স্মৃতি মনে পড়লেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে কিশোরী। তাই তো ভোটের আগে শান্তির বার্তা দিয়ে পৌলমী বলে, “আমার সঙ্গে যা ঘটেছে, তা যেন আর কারোর সঙ্গে না ঘটে।”
কালীগঞ্জের ঘটনা নিয়ে পৌলমীর ঠাকুরমা কাঞ্চন হালদারও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “প্রত্যেক ভোটের সময় এভাবে কেন মানুষের জীবন যাবে? এটা তো ঠিক নয়। কালীগঞ্জের ওই মেয়েটি একেবারে ছোট। সে কিছুই জানে না ভোটের বিষয়ে। তারপরও রাজনৈতিক হিংসায় ওর জীবনটা শেষ হয়ে গেল। এগুলো বন্ধ হোক, প্রশাসন এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিক। সেই আর্জি জানাচ্ছি আমরা।”
তামান্না আর পৌলমীর মতো নিরীহ শিশুদের বলিদান রুখতে রাজনৈতিক দলগুলো কি সত্যি একত্রিত হবে? নাকি প্রতি নির্বাচনের আগে এমন করুণ আর্তি কেবল নিছকই এক আর্তনাদ হয়ে থেকে যাবে? প্রশ্নটা গোটা সমাজের কাছেই।