
প্রতিরক্ষা হোক বা রেল, যেকোনও ক্ষেত্রে সমস্যা শনাক্তকরণ বা বিপদের সংকেত পাওয়ার জন্য সেন্সর অপরিহার্য। বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত সেন্সরের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। তবে এবার এই বিদেশি নির্ভরতা কমাতে উদ্যোগী হয়েছে ভারত সরকার। কলকাতায় তৈরি হচ্ছে একটি সেন্সর হাব, যেখানে প্রতিরক্ষা, রেল, বহুতল ভবন এবং উড়ালপুলে ব্যবহৃত সেন্সর তৈরি হবে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশে সেন্সর উৎপাদনের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সেন্সর হাব তৈরির পরিকল্পনা
ইলেকট্রনিক্স এবং তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রক (MeitY) এই প্রকল্পের জন্য কলকাতার কেন্দ্রীয় গ্লাস এবং সিরামিক গবেষণা ইনস্টিটিউটে (CGCRI) সেন্সর হাব গড়ে তুলতে চলেছে। এই হাবে ফাইবার অপটিক্যাল সেন্সর তৈরি হবে, যা উড়ালপুল, রেলপথ এবং অন্যান্য অবকাঠামোর সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পের জন্য প্রাথমিক অনুমোদন দেওয়া হয়েছে এবং ডিটেইলড প্রজেক্ট রিপোর্ট (DPR) তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
কী ধরনের সেন্সর তৈরি হবে?
এই সেন্সর হাবে পাঁচ ধরনের সেন্সর তৈরি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে:
ফাইবার ব্রাগ গ্রেটিং সেন্সর: রেলপথ, ব্রিজ এবং অন্যান্য অবকাঠামোর চাপ ও কম্পন পরিমাপে ব্যবহৃত হবে।
টেম্পারেচার সেন্সর: তাপমাত্রা পরিবর্তন শনাক্ত করতে ব্যবহার করা হবে।
টিল্ট সেন্সর: অবকাঠামোর ঢাল বা কাত হওয়া পরিমাপে সাহায্য করবে।
ডিসপ্লেসমেন্ট সেন্সর: স্থানচ্যুতি বা স্থানান্তর পরিমাপে ব্যবহৃত হবে।
ফোর্স সেন্সর: বল বা চাপ পরিমাপে ব্যবহার করা হবে।
এই সেন্সরগুলি রেল, প্রতিরক্ষা, নির্মাণ এবং শিল্পক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা যাবে। গবেষকদের মতে, আগামী চার থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে সেন্সরের ক্ষেত্রে বিদেশি নির্ভরতা প্রায় ৪০ শতাংশ কমবে।
সেন্সরের ব্যবহার ও গুরুত্ব
সেন্সরগুলি বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিপদ শনাক্তকরণ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। উদাহরণস্বরূপ:
রেলপথ: ট্র্যাকের ত্রুটি, সিগন্যাল ব্যবস্থার সমস্যা বা চালকের গাফিলতি শনাক্ত করা যাবে।
ব্রিজ ও উড়ালপুল: অবকাঠামোর চাপ, কম্পন বা স্থানচ্যুতি পরিমাপ করে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
মেট্রো রেল: সুড়ঙ্গের ভেতরে লুজ কানেকশন বা অতিরিক্ত চাপ শনাক্ত করা যাবে।
শিল্পক্ষেত্রে: জেনারেটর বা অন্যান্য যন্ত্রপাতির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা সম্ভব হবে।
স্টার্টআপ ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ
এই সেন্সর হাবটি ‘সিএসআইআর-মেইটি ইনোভেশন সেন্টার’ নামে পরিচিত হবে এবং এটি ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT) সেন্সর ও ব্যবসায়িক উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করবে। এটি দেশের প্রথম আইওটি সেন্সর সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান প্রদানকারী স্টার্টআপ হিসেবেও বিবেচিত হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েবেল সহ একাধিক সংস্থা এই প্রকল্পে যুক্ত রয়েছে।
রেলপথে সেন্সরের সফল ব্যবহার
ইতিমধ্যেই শিয়ালদা-বজবজ রেলপথে পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে ‘এফবিজি ডিসপ্লেসমেন্ট’ এবং ‘এফবিজি স্ট্রেন সেন্সর’ ব্যবহার করে রেলের প্যানটোগ্রাফের সমস্যা শনাক্ত করা হচ্ছে। এছাড়াও, ২১০-৫০০ মেগাওয়াটের জেনারেটরের স্বাস্থ্য পরীক্ষায় সেন্সর ব্যবহার করে সফলতা পাওয়া গেছে।
উপসংহার
কলকাতায় সেন্সর হাব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারত সেন্সর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই উদ্যোগ শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও রেলক্ষেত্রেই নয়, বরং দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো ও শিল্পক্ষেত্রেও বিপ্লব ঘটাবে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে সেন্সর প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারতের বিদেশি নির্ভরতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।