
ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটের পরিচিত মুখ এবং সম্ভাবনাময় ক্রিকেটার সরফরাজ খান। ব্যাট হাতে রানের পাহাড় গড়লেও অতীতে তার মেদবহুল শরীর এবং ফিটনেসের অভাব নিয়ে কম কটু কথা শুনতে হয়নি। আধুনিক ক্রিকেটে ফিটনেস যেখানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সেখানে যেন বড্ড বেমানান মনে হতো সরফরাজকে। চারদিকে সমালোচনা দেখে ভারতের কিংবদন্তি ক্রিকেটার সুনীল গাভাস্কার একবার বলেই ফেলেছিলেন, নির্বাচকদের শুধু ওজন নয়, একজন ব্যাটারের পারফরম্যান্স দেখা উচিত।
ফিটনেস নিয়ে সচেতনতা ও লক্ষ্য:
কিন্তু এবার নিজেকে আমূল বদলে ফেলার যুদ্ধে নেমেছেন সরফরাজ খান, যার লক্ষ্য ভারতীয় দলে প্রত্যাবর্তন। তিনি জানেন, নিজেকে না বদলালে ভারতীয় দলে সুযোগ পাওয়া কঠিন। তার ব্যাটিং প্রতিভায় বিশেষ খামতি নেই, খামতি তার ফিটনেসে। টেস্ট ক্রিকেটে পাঁচ দিন খেলার ধকল, মাঠে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফিল্ডিং করার জন্য দরকার পেটানো চেহারা এবং ক্ষিপ্র নড়াচড়া। তিনি জানেন, হয়তো এমন অনেকে ভারতীয় দলে সুযোগ পাচ্ছেন, যাদের ব্যাটিং প্রতিভা তার তুলনায় কম, কিন্তু তাদের নড়াচড়া অনেক ক্ষিপ্র। সেই কারণেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঘরের মাঠে ১৫০ রান করেও ভারতের টেস্ট দলে ব্রাত্য হয়ে গিয়েছিলেন সরফরাজ। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া সফরেও তাকে রিজার্ভ বেঞ্চেই থাকতে হয়েছিল।
পরিবারের সমর্থন ও ওজন কমানোর যুদ্ধ:
সরফরাজ শুধু নিজেই নন, ফিটনেস নিয়ে এবার সচেতন হয়েছেন তার বাবা এবং কোচ নওশাদ খানের নেতৃত্বে পুরো পরিবার। তাকে সাহায্য করতে কঠোর ডায়েট শুরু করেছেন পরিবারের বাকি সদস্যরাও। নওশাদ খান ভারতীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পরিবারের সকলে মিলেই ওজন কমানোর যুদ্ধে নেমেছেন। সকলে মিলেই এই লড়াই জিততে চান তারা।
কঠোর ডায়েটের বিবরণ:
এই লড়াইটা অবশ্য খুব একটা সহজ ছিল না। পছন্দের চিকেন ও মটন বিরিয়ানি ছাড়তে হয়েছে সরফরাজকে। এমনকি, ভাত-রুটিও বন্ধ। অর্থাৎ, তার খাদ্যতালিকায় কোনও কার্বোহাইড্রেট নেই। সরফরাজকে ফিট রাখতে খাদ্যাভ্যাস পুরোপুরি বদলে ফেলেছে গোটা পরিবার। নওশাদ খানের কথায়, ‘পরিবারের সকলে মিলেই ওজন কমানোর যুদ্ধে নেমেছি। ডায়েট পুরো বদলে ফেলেছি। ভাত, রুটি, চিনি বন্ধ। দেড় মাস ধরে ও সব খাইনি। তার বদলে সবজি খাচ্ছি বেশি করে। ব্রকোলি, গাজর, শশা, স্যালাদসহ বিভিন্ন সবজির দিকে মন দিয়েছি। চিকেন, ডিম সবকিছুই সেদ্ধ করে খাচ্ছি। আর খাচ্ছি গ্রিন টি এবং গ্রিন কফি।”
শারীরিক কসরত ও রুটিন:
শুধু খাদ্যাভ্যাস নয়, গত দেড় মাস ধরে দিনের গোটা রুটিনই বদলে ফেলেছেন বাবা-ছেলে। নওশাদ বললেন, ‘ভোর সাড়ে ৫টায় বাড়ি থেকে বের হই। ১৫ কিলোমিটার দূরে ক্রস ময়দানে যাই। সেখানে প্রথমে ওয়ার্ম আপ করি। তার পর সরফরাজ কিছুক্ষণ দৌড়য়। দৌড়ের পর ফিল্ডিং অনুশীলন করে। তার পরে ব্যাট করে। সাড়ে ১০টা নাগাদ বাড়ি ফিরে প্রাতরাশ সেরে বিশ্রাম নিই।” সন্ধ্যায় মুম্বাই ক্রিকেট সংস্থার জিমে যান সরফরাজ ও নওশাদ। সপ্তাহে ছয়দিন। জিমে ঢোকার আগে সরফরাজ আধ ঘণ্টা করে দৌড়ান আর সাঁতার কাটেন। সেই সময়টা হনহন করে হাঁটেন নওশাদ। তার পরে জিম শুরু হয়। রাতে বাড়ি ফিরে নৈশভোজ সেরে ঘুম।
ফল মিলেছে:
এই কড়া ডায়েট ও রুটিনের সুফলও পেয়েছেন সরফরাজ। মাত্র মাস দেড়েকে নিজেকে বদলে ফেলেছেন অনেকটাই। ৮৬ কেজি থেকে এখন তিনি ৭৬ কেজি—অর্থাৎ ১০ কেজি ওজন কমিয়েছেন। শুধু সরফরাজ়ের ক্ষেত্রে নয়, তার বাবা নওশাদ খানের ওজনও ১২ কেজি কমেছে এবং ছোট ছেলে মইনও ওজন কমিয়েছে।
ব্যাটিং অনুশীলনও চলছে পুরোদমে:
জিম ও শারীরিক কসরতের পাশাপাশি নিজের ব্যাটিং নিয়েও বাড়তি পরিশ্রম করছেন সরফরাজ। তিনি জানেন, শেষ পর্যন্ত রানই আসল। তাই সরফরাজের ব্যাটিং অনুশীলনে কোনও খামতি যাতে না হয়, সে দিকেও নজর রয়েছে তার। দিনে তিন বার ব্যাটিং অনুশীলন করেন সরফরাজ। নওশাদ বললেন, ‘সকালে ক্রস ময়দানে সরফরাজ লাল বলে ব্যাট করে। বাড়ি ফিরে প্রাতরাশের পর আবার ব্যাট করতে নামে। আমাদের বাড়িতেই পিচ আছে। সেখানে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ বল খেলে। সামনে টেস্ট সিরিজ আছে বলে দ্বিতীয় দফার ব্যাটিং অনুশীলনও হয় লাল বলে। তারপর সন্ধ্যায় জিমের পর আবার ব্যাট করে। তখন সাদা বলে।’
বিরাট কোহলি টেস্ট থেকে অবসর নেওয়ায় ভারতের মিডল অর্ডারে একটা জায়গা কার্যত ফাঁকা। সেই চার নম্বর জায়গাটা নেওয়ার লড়াইয়ে রয়েছেন অনেকে। শ্রেয়াস আয়ার, লোকেশ রাহুলের পাশাপাশি ঘরোয়া ক্রিকেটে রান করা করুণ নায়ারও দলে ঢোকার চেষ্টা করছেন। সরফরাজ জানেন, তার জায়গা পাওয়া কঠিন। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী? সেই লক্ষ্যেই নিজেকে বদলানো। ভারত ‘এ’ দলের হয়ে রান করে নির্বাচকদের নজরে পড়তে হবে তাকে। দ্বিতীয় বার সুযোগ পেলে যাতে ফিটনেস ‘অন্তরায়’ হয়ে না দাঁড়ায়। ফিটনেস এবং ব্যাটিং – দুই দিকেই সমান মনোযোগ দিয়ে সরফরাজ খান ভারতীয় দলে প্রত্যাবর্তনের জন্য মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এই লড়াই এবং পরিবারের সমর্থন অনেক তরুণ ক্রিকেটারের জন্য অনুপ্রেরণা।