একই ব্যক্তি, দুই দেশ, মালদায় ফাঁস ভয়ঙ্কর জালিয়াতি চক্রের রহস্য!

প্রয়াত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন ‘এপারে যে বাংলাদেশ, ও পারে সেই বাংলা’, দুই বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্য বোঝাতে। কিন্তু কে ভেবেছিল যে, এপারে সেলিম শেখ আর ওপারে মহম্মদ দিলওয়ার – একই ব্যক্তির দুই ভিন্ন পরিচয়? মালদার মহদিপুর ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্টে (আইসিপি) এমনই এক চাঞ্চল্যকর জালিয়াতি চক্রের পর্দা ফাঁস হয়েছে, যা ভারতীয় পরিচয়পত্র তৈরির এক বিশাল কারসাজির দিকে আঙুল তুলছে।

ইমিগ্রেশন কাউন্টারে লাল বাতি, অতঃপর রহস্যের উন্মোচন
ঘটনার সূত্রপাত গত বৃহস্পতিবার দুপুরে, যখন ৩১ বছর বয়সী এক যুবক ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে মহদিপুর আইসিপিতে বাংলাদেশ যাওয়ার জন্য ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আসেন। পাসপোর্টে তার নাম সেলিম শেখ, ঠিকানা মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলা থানার বাজিতপুর কালুখালি গ্রাম। কিন্তু যখন আইসিপির আধিকারিকরা তাঁর পাসপোর্টটি রিডার স্ক্যানারে ফেলেন, তখনই ঝলসে ওঠে লাল আলো! মেশিন সংকেত দেয় যে এই পাসপোর্ট নম্বরের জন্য কলকাতার ফরেনার্স রিজিওনাল রেজিস্ট্রেশন অফিস (FRRO) এবং ব্যুরো অফ ইমিগ্রেশন (BOI) থেকে একটি লুক আউট অর্ডার (LOC) জারি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন আধিকারিকরা।

মোবাইল ফোনে সূত্রপাত, বেরিয়ে এল বাংলাদেশের পরিচয়
প্রাথমিক জেরায় সেলিম ওরফে দিলওয়ারের মোবাইল ফোন পরীক্ষা করে অসংখ্য ছবি পাওয়া যায়। বেশিরভাগ ছবিতেই তাকে একজন মহিলা ও মাস ছয়েকের এক বাচ্চার সঙ্গে দেখা যায়। শুরুতে তদন্তকারীদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলেও, তার ফোনেই একটি জমির দলিলের ছবি পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশের। সেই দলিলে মহম্মদ দিলওয়ার হোসেন নাম এবং বাংলাদেশের নাগরিক পরিচয়পত্রের নম্বর উল্লেখ ছিল।

তদন্তকারীরা সেই নম্বর বাংলাদেশ এমব্যাসিতে পাঠালে দ্রুত নিশ্চিত করা হয় যে, মহম্মদ দিলওয়ার হোসেন একজন বাংলাদেশি নাগরিক। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এমব্যাসি থেকে দিলওয়ারের পরিচয়পত্রের প্রতিলিপিও মহদিপুর আইসিপিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপরই বৃহস্পতিবার দুপুরে সেলিম ওরফে দিলওয়ারকে ইংরেজবাজার থানায় হস্তান্তর করা হয়। শুক্রবার তাকে মালদা জেলা আদালতে তোলা হলে মুখ্য বিচার বিভাগীয় বিচারক ছ’দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন।

৬ দিনের জিজ্ঞাসাবাদে চাঞ্চল্যকর স্বীকারোক্তি
ইংরেজবাজার থানার পুলিশ ধৃতের কাছ থেকে ভারতীয় পাসপোর্ট, ভোটার ও আধার কার্ড, ভিসা, এবং কিছু ভারতীয় টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে। পুলিশি জেরায় প্রথমে ওই যুবক নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বাংলাদেশি পরিচয়পত্রটি তার ছবি ব্যবহার করে কারসাজি করা হয়েছে বলেও দাবি করেন। এমনকি, বাংলাদেশে তার অসুস্থ মামাকে দেখতে যাচ্ছেন বলেও মিথ্যা দাবি করেন।

কিন্তু দফায় দফায় পুলিশি জেরায় একসময় ভেঙে পড়েন তিনি। এরপর তার মুখ থেকে যা বেরিয়ে আসে, তা শুনে তদন্তকারী পুলিশ আধিকারিকরা তাজ্জব হয়ে যান। তার জবানবন্দি গত ১০ জুন ইটিভি ভারতে প্রকাশিত বাংলাদেশিদের ভারতীয় হয়ে ওঠার বিস্তারিত খবরের সত্যতায় শুধু সিলমোহর দিয়েছে।

২০০৭ সাল থেকে ভারতে, জাল নথিপত্রের বিস্তারিত কাহিনি
ধৃত যুবক পুলিশকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে তার বাবা-মা, এক ভাই, দুই বোন, স্ত্রী ও মাস ছয়েকের কন্যাসন্তান রয়েছে। ২০০৭ সালে তিনি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের লালগোলা এলাকার সীমান্ত পেরিয়ে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেন। এরপর শিলিগুড়ি সংলগ্ন জলপাইগুড়ি জেলার কাওয়াখালিতে মাসির বাড়ি যান। কয়েকদিন পর বাড়ির লোকজন দেশে ফিরে গেলেও তিনি মাসির বাড়িতেই থেকে যান।

২০২০ সাল থেকে তিনি ভারতীয় নাগরিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করেন। মাসি ও মেসোকে মা-বাবা সাজিয়ে সেখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে জন্মের শংসাপত্র সংগ্রহ করেন। এক্ষেত্রে মাসিরাও দালাল খুঁজে দিতে তাকে সাহায্য করেছেন। জন্মের শংসাপত্র বেরোনোর পর দালালের মাধ্যমে একে একে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড বানিয়ে নেন। এরপর পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ২০২২ সালে তার হাতে ভারতীয় পাসপোর্ট চলে আসে। এই ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করেই তিনি বৈধভাবে একাধিকবার বাংলাদেশে যান, সেখানে বিয়ে করেন এবং সম্প্রতি তার একটি মেয়েও হয়েছে। মেয়েকে দেখতেই তিনি ফের বাংলাদেশ যাচ্ছিলেন।

চক্রের শিকড় সন্ধানে পুলিশ
সম্প্রতি গাজোল থানার পুলিশ গাজোল ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের রসিকপুর গ্রাম থেকে বাংলাদেশি সন্দেহে তিনজনকে গ্রেফতার করেছিল। প্রাথমিক জেরায় ধৃতরা স্বীকার করে যে তারা বাংলাদেশের বাসিন্দা এবং প্রায় দশ বছর আগে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করেছে। তাদের কাছে কোনো বৈধ নথি নেই, আধার কার্ড থাকলেও ভোটার কার্ড বা পাসপোর্ট হয়নি। এই ঘটনার পর বর্তমান ঘটনাটি জেলা পুলিশের অন্দরে শোরগোল ফেলে দিয়েছে। তাই ধৃত সেলিম ওরফে দিলওয়ারকে জেরা করে এই দালালচক্রের শিকড়ে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে জেলা পুলিশ।

জেলা পুলিশ সুপার প্রদীপ কুমার যাদব এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এই ঘটনায় মহদিপুর আইসিপির তরফে ইংরেজবাজার থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আদালতের অনুমতিক্রমে তাকে পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। জেরায় ধৃত ব্যক্তি স্বীকার করেছেন তিনি বাংলাদেশি নাগরিক। অবৈধভাবে তিনি ভারতীয় বিভিন্ন পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট হস্তগত করেছেন। এই মামলায় ইতিমধ্যে কিছু প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে, যাতে তাকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসাবে প্রমাণ করা যায়। ধৃতের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে। আরও তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।”

এই ঘটনা আবারও ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং জাল পরিচয়পত্র তৈরির ভয়ঙ্কর চক্রের বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে এল। এই চক্রের মূল হোতাদের খুঁজে বের করা এখন তদন্তকারীদের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy