
বর্ষা এখনো পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসেনি, কিন্তু বাঙালির রসনাজুড়ে ইতিমধ্যেই ইলিশের সুবাস। দু’মাসের দীর্ঘ নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটিয়ে ইলিশের খোঁজে ফের বঙ্গোপসাগরে পাড়ি জমাচ্ছে মৎস্যজীবীদের ট্রলার। তবে এবারের যাত্রাটা একটু ভিন্ন, আরও সুরক্ষিত এবং আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সমৃদ্ধ। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরোর (ISRO) তৈরি অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইলিশ শিকারের প্রস্তুতি নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
“স্যাটেলাইট বেজড মেরিটাইম সেফটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সিস্টেম” – মৎস্যজীবীর নতুন বন্ধু
এবার ইলিশ ধরা ট্রলারগুলোতে বসানো হয়েছে স্যাটেলাইট বেজড মেরিটাইম সেফটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সিস্টেম ডিভাইস, বা সংক্ষেপে ট্রান্সপন্ডার। এই অত্যাধুনিক যন্ত্রটি গভীর সমুদ্রে, যেখানে সাধারণত নেটওয়ার্ক কাজ করে না, সেখানেও কার্যকর। এর প্রধান সুবিধাগুলো হলো:
- বিপদ সংকেত প্রেরণ: গভীর সমুদ্র থেকে যেকোনো বিপদসংকেত তাৎক্ষণিকভাবে উপকূলে পাঠানো যাবে।
- সীমান্ত সুরক্ষা: ভারতীয় জলসীমা থেকে ভুলবশত বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করলেই ট্রলারে সংকেত পাঠাবে এই যন্ত্র।
- ইলিশের ঝাঁকের অবস্থান: এই প্রযুক্তির সাহায্যে বঙ্গোপসাগরের গভীরে ইলিশের ঝাঁক কোথায় অবস্থান করছে, তাও বোঝা যাবে। এতে মৎস্যজীবীদের সময় ও শ্রম দুটোই বাঁচবে।
ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কাকদ্বীপ মহকুমার ৩০০টিরও বেশি ট্রলারে এই অত্যাধুনিক যন্ত্র স্থাপন করা হয়েছে। কাকদ্বীপ ছাড়াও সুন্দরবন উপকূল এলাকার নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ, পাথর প্রতিমা, রায়দিঘির ঘাটের বেশ কিছু ট্রলারেও এই আধুনিক যন্ত্র লাগানো হয়েছে।
নিষেধাজ্ঞার অবসান, নিরাপত্তার নতুন বার্তা
প্রতি বছর ইলিশসহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে গত ১৫ই এপ্রিল থেকে ১৪ই জুন পর্যন্ত সমুদ্রে সব ধরনের মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মৎস্য দপ্তর। সেই নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার পরই ইসরোর প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে এবার ইলিশ ধরতে বেরোচ্ছেন মৎস্যজীবীরা।
মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তাদের জীবনবিমা করে দেওয়া হয়েছে। মৎস্যজীবী সংগঠন সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি ট্রলারে ১৫ জন করে জেলে থাকবেন। গভীর সমুদ্রে রওনা দেওয়া মৎস্যজীবীদের সতর্ক করতে বন্দরে মাইকিং চলছে, যেখানে লাইফ জ্যাকেট ব্যবহারের গুরুত্ব তুলে ধরা হচ্ছে। এছাড়া, সমুদ্রে মাছ ধরার সময় ভারতীয় নৌবাহিনী ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যাতে বিপদে পড়লে উদ্ধারকারী দল দ্রুত পৌঁছাতে পারে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনার সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা সুজিত বাগ জানিয়েছেন, “রবিবার ও সোমবার ভোর থেকে ধাপে ধাপে ট্রলার সমুদ্রে রওনা দিচ্ছে। কড়া নজরদারির মধ্যে নিয়মনীতি মেনে মাছ ধরতে যাচ্ছেন মৎস্যজীবীরা।”
আশায় বুক বাঁধছেন মৎস্যজীবী ও ইলিশপ্রেমীরা
ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনাইটেড ফিশারম্যান অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সম্পাদক বিজন মাইতি জানান, গত কয়েক বছরের মৌসুমের শুরুতে পর্যাপ্ত মাছ না পাওয়ার কারণে সব ট্রলার এবার একসঙ্গে সমুদ্রে যাবে না। ধাপে ধাপে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে রওনা দেবে তারা।
ইসরোর সহযোগিতার ফলে মৎস্যজীবীরা এবার অনেক বেশি ইলিশ পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছেন। তাদের আশা, চলতি বছরে রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে। তবে ইলিশ ধরার কিছু নির্দিষ্ট নিয়মও রয়েছে, যেমন জালের ফাঁস ৯০ মিলিমিটার হতে হবে এবং ২৩ সেন্টিমিটারের ছোট ইলিশ ধরা যাবে না।
এই নতুন প্রযুক্তি ইলিশ শিকারের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে একদিকে যেমন মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা বাড়বে, তেমনি ইলিশের ফলনও বৃদ্ধি পাবে, যা ভোজনরসিক বাঙালির পাতে নিয়ে আসবে রুপোলি শস্যের অবাধ জোগান।