
মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে নতুন করে অশনি সংকেত। ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ – এই কোড নামে আজ ইরানে বড় ধরনের হামলা চালিয়েছে ইজরায়েল। তাদের দাবি, এর মূলে রয়েছে ইরানের ক্রমবর্ধমান পারমাণবিক কর্মসূচি, যা ইজরায়েলের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি। ইজরায়েল বারবার অভিযোগ করে আসছে যে, ইরান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে এবং এর প্রমাণও তারা বহুবার তুলে ধরেছে। কিন্তু এবারের আক্রমণের প্রেক্ষাপটে উঠে এল এক চাঞ্চল্যকর তথ্য – পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক সংযোগের পুরোনো ইঙ্গিত!
২০১৮ সাল। ইজরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ এক দুর্ধর্ষ অভিযান চালিয়ে ইরানে প্রবেশ করে। তাদের লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সংক্রান্ত গোপন নথি চুরি করা। সেই দুঃসাহসিক অভিযানে মোসাদ সফল হয়, এবং হাতে আসে এমন কিছু নথি, যা কেবল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষাই নয়, বরং এক আদি পর্বে পাকিস্তান থেকে পারমাণবিক প্রযুক্তি সংক্রান্ত তথ্য পাওয়ার এক গোপন ইঙ্গিতও ফাঁস করে দিল।
ইজরায়েল যখন ২০১৮ সালে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কিত নথি চুরি করে, তখন তা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ওয়াইনেট নিউজের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মোসাদের এই গোপন গোয়েন্দা অভিযানে উদ্ধার হওয়া ৫৫ হাজার পৃষ্ঠার নথিতে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পরিকল্পনার সমস্ত বিস্তারিত তথ্য ছিল। মোসাদ এজেন্টরা হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে ইরানে প্রবেশ করে, সেফ রুমে রাখা এই গোপন পারমাণবিক নথিগুলো উদ্ধার করে ইজরায়েলে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। এতে ইরানের গোপন সামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পর্কে সমস্ত গোপনীয়তা প্রকাশ পায়।
ইজরায়েলি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বলছে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি ১৯৯২ বা ১৯৯৩ সালে গতি পেতে শুরু করে। এই সময়েই ইরানিরা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের জন্য সেন্ট্রিফিউজ উৎপাদন ও পরিচালনার প্রযুক্তি অর্জনে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
মোসাদের উদ্ধারকৃত নথি থেকেই এই গুরুতর ইঙ্গিত বেরিয়ে এসেছে: তেহরান তার বেশিরভাগ তথ্য পেয়েছিল পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্পের তৎকালীন ডিরেক্টর আব্দুল কাদির খানের কাছ থেকে। পরে চীনের মতো অন্যান্য উৎস থেকেও এই কর্মসূচির তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ইজরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে আসা নথিগুলি পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ইরানের পারমাণবিক প্রযুক্তির প্রাথমিক পাঠ শুরু হয়েছিল পাকিস্তান থেকে।
এরপরই ইরান তার পারমাণবিক কর্মকাণ্ড আরও বাড়ায়। প্রথমে তারা ‘দামাবান্দ’ নামক স্থানে সেন্ট্রিফিউজ ডিজাইন করেছিল। ইজরায়েলের সতর্কতার পর ইরান সেই স্থাপনা ধ্বংস করে নতুন একটি কেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। এই স্থানটিই পরবর্তীতে নাতাঞ্জ পারমাণবিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ইরানি নথিতে এই স্থানটিকে ‘কাশান’ বলা হতো, এবং এখানে সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছিল। আজ শুক্রবার বিমান হামলা চালিয়ে এই পারমাণবিক কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দিয়েছে ইজরায়েল। এর বাইরেও ইরানের ইসফাহান এবং ফোর্ডোর মতো অন্যান্য পারমাণবিক কেন্দ্র ছিল। ইজরায়েল এই স্থানগুলিতেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার কথা ঘোষণা করেছে।
সব মিলিয়ে, ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’ কেবল একটি সামরিক হামলা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক সংঘাতের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল, যার পেছনে পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের এক পুরোনো ও বিতর্কিত সংযোগের ভূতও নতুন করে উঁকি দিচ্ছে। বিশ্ব এখন গভীর উদ্বেগে তাকিয়ে আছে, এই ‘লায়ন’-এর গর্জন কোথায় গিয়ে থামে।