ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রে মার্কিন হামলা, বিশ্বজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, কোন দেশ কি বলছে?

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর নজিরবিহীন হামলার ঘটনায় বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া, যা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুন করে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। একদিকে রাশিয়া ও চীনের মতো দেশগুলো এই হামলাকে বৈশ্বিক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ানোর অভিযোগ তুলছে, অন্যদিকে ইউরোপের কিছু দেশ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পদক্ষেপকে সমর্থন জানিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিক্রিয়া: মধ্যপ্রাচ্যে এই হামলা নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করেছে বিভিন্ন দেশ। সৌদি আরব ইরানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, ওমান, যেখানে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে, তারা এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে এবং উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে।

মিশর এই উত্তেজনা বৃদ্ধির নিন্দা জানিয়ে বলেছে, জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের যেকোনো লঙ্ঘনের নিন্দা জানায় তারা, বিশেষ করে যেকোনো রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ওপর জোর দিয়েছে দেশটি। মিসর সতর্ক করে বলেছে, এই অঞ্চলের বিপদ আরও সংঘাত ও উত্তেজনার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করে বলেছে, বর্তমান বিপজ্জনক উত্তেজনা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। দেশটি সব পক্ষকে বিবেচনা ও সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে।

ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার নিন্দা জানিয়ে ইরাক বলেছে, শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচিকে লক্ষ্যবস্তু করার মাধ্যমে ওয়াশিংটন বিপজ্জনকভাবে উত্তেজনা বৃদ্ধি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করেছে। বাগদাদ উত্তেজনা প্রশমনে দ্রুত কূটনৈতিক আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী জোসেফ আউন বলেছেন, এই বোমা হামলা উত্তেজনা আরও বাড়াতে পারে, যার ফলে আঞ্চলিক ও একাধিক দেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।

তেহরানের মিত্রদের কঠোর নিন্দা: ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলায় জোরালো নিন্দা জানিয়েছে তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও রাশিয়া। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থার নজরদারিতে থাকা ওই স্থাপনাগুলোয় হামলার জোর নিন্দা জানায় বেইজিং। চীনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলা জাতিসংঘ সনদের পরিষ্কার লঙ্ঘন এবং মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেবে। বেইজিং সকল পক্ষকে হামলা বন্ধ করে দ্রুত আলোচনায় ফেরার তাগিদ দিয়েছে।

অন্যদিকে, মার্কিন হামলার তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করেছে রাশিয়া। মস্কো বলেছে, “কোনো ন্যায্যতা ছাড়া একটি সার্বভৌম দেশের ওপর এই হামলা একটি দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত; যা জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন ও নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার লঙ্ঘন।” রাশিয়া ‘সকল ধরনের আগ্রাসন’ বন্ধের দাবি জানিয়েছে এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সকল পক্ষকে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে।

ইউরোপের বিভক্ত অবস্থান: ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান কায়া কাল্লাস বলেছেন, “ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া যাবে না। কারণ এটি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে।” তিনি সব পক্ষকে সংযত হওয়া, আলোচনার টেবিলে ফিরে আসা এবং ভবিষ্যৎ উত্তেজনা এড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করে বলেছেন, “ট্রাম্প প্রশাসন এমন পদক্ষেপ নিয়েছে; যা ইরানকে পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার হুমকি ‘হ্রাস’ করতে সহায়ক হবে।” রোববার সকালের দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (আগের টুইটার) দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, “ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি। ইরানকে কখনই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে দেওয়া হবে না।” ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইরানকে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসার এবং এই সংকটের কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার আহ্বান জানিয়েছেন।

লাতিন আমেরিকার প্রতিবাদ: লাতিন আমেরিকায়, চিলি, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা এবং কিউবার রাষ্ট্রপ্রধানরা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট লুইস আর্স এবং কিউবার প্রেসিডেন্ট রাফায়েল দিয়াজ-কানেল যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে জাতিসংঘ সনদের লঙ্ঘন এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে নিন্দা জানিয়েছেন।

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাকে ‘একটি অবৈধ, অযৌক্তিক এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক আগ্রাসনের কাজ’ বলে অভিহিত করেছে। চিলির প্রেসিডেন্ট গাব্রিয়েল বোরিচ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা এই অর্থে ব্যবহার করা উচিত নয়, যে তারা মানবজাতি হিসেবে আমরা যেসব নিয়ম তৈরি করেছি, তা লঙ্ঘন করতে পারে।”

বিবিসি সূত্রে জানা গেছে, এই হামলার পর আন্তর্জাতিক মহলে বিভেদ আরও প্রকট হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy