
আর ক’দিন বাদেই মহাধুমধামের সঙ্গে পালিত হবে শ্রী জগন্নাথের পবিত্র রথযাত্রা। পুরীর পাশাপাশি দেশের অন্যান্য শহরেও এই উৎসব পালিত হয় অপার ভক্তি ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। অক্ষয় তৃতীয়ার পুণ্য তিথিতে শুরু হয়ে গেছে রথ নির্মাণের কাজ, যা এই বিশাল আয়োজনের প্রথম ধাপ। এই রথযাত্রা কেবল একটি উৎসব নয়, এটি জগন্নাথ সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভক্তদের হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে।
রথযাত্রার জন্য ভগবান শ্রী কৃষ্ণ (জগন্নাথ), বলরাম এবং সুভদ্রার জন্য তিনটি পৃথক রথ প্রস্তুত করা হয়। আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে এই তিনটি সুবিশাল রথকে পুরীর সিংহদ্বারে নিয়ে আসা হয়। এরপর মন্দিরের মূর্তিগুলিকে বিশেষ স্নান করানো হয় এবং নতুন বস্ত্র ও অলঙ্কারে সজ্জিত করা হয়। এই পবিত্র আচার-অনুষ্ঠানের পরই দেব-দেবী তাঁদের রথে আরোহণ করেন, যা রথযাত্রার সূচনা করে।
বিশ্রাম যাত্রা ও ৫৬ ভোগের মাহাত্ম্য:
মন্দির চত্বরে ভক্তদের দর্শন দেওয়ার পর ভগবান জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মূর্তিগুলিকে মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে বিশ্রাম দেওয়া হয়। এই ‘বিশ্রাম যাত্রা’ এক গুরুত্বপূর্ণ আচার। এই সময় দেবতাদের জন্য ছাপ্পান্ন ভোগ (Chappan Bhog) নিবেদন করা হয়। এই ৫৬টি পদ কেবল সাধারণ খাবার নয়, এগুলি ভক্তদের চরম ভক্তি ও নিষ্ঠার প্রতীক। বিশ্বাস করা হয়, স্বয়ং দেবী লক্ষ্মী এই ভোগের তত্ত্বাবধান করেন এবং নিশ্চিত করেন যে প্রতিটি পদ যেন অত্যন্ত যত্ন ও পবিত্রতার সঙ্গে প্রস্তুত হয়।
এই ছাপ্পান্ন ভোগ ছয়টি ভিন্ন ভাগে নিবেদন করা হয়, যা দিনের বিভিন্ন খাবারের সময়কে নির্দেশ করে। এই ভোগগুলি শুধুমাত্র ঈশ্বরের প্রতি নিবেদন নয়, এটি পুরীর এক অতুলনীয় রন্ধনশিল্পের ঐতিহ্যকেও তুলে ধরে।
ভোগের তালিকা – এক ঝলকে:
প্রাত্যহিক এই ভোগগুলির মধ্যে রয়েছে বিচিত্র সব পদ। গোপাল বল্লভ ভোগ (সকাল ৮:৩০) দিয়ে শুরু হয় দিন, এরপর সাকালা ধুপা (সকাল ১০টা), ভোগ মন্ডপ ভোগ (বেলা ১১টা), মধ্যনহা ধুপা (দুপুর ১২:৩০ – ১টা), সন্ধ্যা ধুপা (সন্ধ্যা ৭টা – ৮টা) এবং সবশেষে বড় শ্রুঙ্গারা ভোগ (রাত ১১টা)।
এই ৫৬টি পদের মধ্যে রয়েছে নানা ধরনের ভাত, যেমন – সাদা অন্ন, দই পাখালা, ঘি অন্ন, খিচুড়ি। মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে আছে খাজা, গজা, লাড্ডু (জিরা লাডু, মাগাজা লাডু), মিঠাপুলি, কাকারা, জগবল্লভ, ইত্যাদি। পিঠা ও মন্ডার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুয়ার পিঠা, চাড়াই লারা, ঝিলি, মন্ডা এবং আমলু। দুধের তৈরি পদের মধ্যে পায়েস, পাপুরি, রসবালি, তারিয়া, চেনা খাই এবং সবচেয়ে জটিল সারাপুল্লি বিশেষ আকর্ষণ। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ডাল (বিউলির ডাল, মুগ ডাল, মটরের ডাল), তরকারি (দালামা, বেসর, সাগা), রায়তা এবং বিভিন্ন ভাজা ও টক আইটেমও থাকে।
এই প্রতিটি পদই তৈরি হয় অসামান্য যত্ন এবং ঐতিহ্যবাহী রন্ধনপ্রণালী অনুসরণ করে, যা জগন্নাথ মন্দিরের ঐশ্বর্য ও গভীর আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। রথযাত্রার এই পবিত্র সময়ে ভক্তরা কেবল রথের রশিই টানে না, তারা এই দৈব ভোগের মাধ্যমে ঈশ্বরের নৈকট্যও অনুভব করে।