আয়াতোল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করার ডাক যুবরাজ রেজার, ইরানের রাজনীতিতে নতুন মোড়, ফিরে কি আসছে রাজতন্ত্র?

ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে, আমেরিকার সুরও নরম হয়েছে। কিন্তু এরই মাঝে ইরানের আকাশে নতুন করে অস্থিরতার ইঙ্গিত। কারণ, নির্বাসিত যুবরাজ রেজা পহলভি বিদেশ থেকে দেশের সর্বোচ্চ শাসক আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেইকে ক্ষমতাচ্যুত করার সরাসরি ডাক দিয়েছেন। তিনি ঘোষণা করেছেন, ইরানের শাসনভার হাতে নিয়ে তিনি দেশে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন।

রেজার জ্বালাময়ী ভাষণ ও ‘নতুন ইরান’-এর স্বপ্ন:

ইরান-ইজরায়েল সংঘাতের আবহে পরিবর্তনের সুর টেনে সরব হন রেজা। সোমবার এক জ্বালাময়ী ভাষণে তিনি বলেন, “বার্লিন দেওয়ালের সেই সন্ধিক্ষণ উপস্থিত হয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। ইরানের নাগরিকদের একজোট হতে হবে, স্বৈরাচার, একনায়কতন্ত্র মুক্ত দেশ গড়ে তুলতে হবে। স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ইরান, যেখানে প্রতিবেশীদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক থাকবে আমাদের। উন্নয়ন এবং সুযোগের অভাব থাকবে না যেখানে।”

রেজার এই বক্তৃতা অনেকের মনেই জল্পনা তৈরি করেছে যে, তিনি কি ইরানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার দিকে এগোচ্ছেন? দীর্ঘ পাঁচ দশক ধরে নির্বাসনে থাকা রেজা কেন হঠাৎ ইরানকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, তার জবাবও তিনি নিজেই দিয়েছেন। স্পষ্ট ভাষায় তিনি বলেন, “দেশকে পরিবর্তনের পথে নেতৃত্ব দিতে চাই আমি। আমার ভাবনা খুব স্পষ্ট।”

ট্রাম্পের অবস্থান বদল ও রেজার অনড়তা:

ইরানের সঙ্গে ইজরায়েলের সংঘাত যখন তুঙ্গে ছিল এবং আমেরিকা তেহরানের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রে হামলা চালাচ্ছিল, সেই সময়ই রেজার এই সরব হওয়া যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ওই সময়ে আমেরিকাতেও ইরানের ক্ষমতার রদবদলের পক্ষে সওয়াল করতে শোনা যাচ্ছিল। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার MAGA স্লোগান অনুসারে ‘MIGA’ অর্থাৎ “Make Iran Great Again” এর ডাক দেন এবং খামেনেইকে আত্মসমর্পণের হুঁশিয়ারিও দেন। তবে যুদ্ধবিরতির পর ট্রাম্প যদিও উল্টো সুর গেয়ে দাবি করছেন, ইরানে শাসক বদলের কোনও অভিসন্ধি নেই।

তবে রেজার অবস্থান অবিচল। খামেনেইকে উৎখাত করতে সামরিক পদক্ষেপেও তাঁর আপত্তি নেই। তিনি খামেনেই বিরোধী লোকজনকে একত্রিত করতে একটি নিরাপদ প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার কথা জানিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, “আমরা গর্বিত জাতি, প্রাণবন্ত জাতি, প্রাচীন সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা। আমি পাশে আছি আপনাদের। চলুন একসঙ্গে নতুন ইরান তৈরি করি।”

কে এই রেজা পহলভি?

রেজা পহলভি হলেন ইরানের শেষ শাহ মহম্মদ রেজা পহলভির জ্যেষ্ঠপুত্র। ১৯৪১ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত ইরান শাসন করেন মহম্মদ শাহ। তাঁর স্বৈরাচারী শাসন, অর্থনৈতিক অসাম্য এবং পশ্চিমা শক্তির প্রভাবের বিরুদ্ধে ১৯৭৮ সালে ইরানে বিপ্লব শুরু হয়, যা ১৯৭৯ সালে শাহের পতন ঘটায়। ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে ম্যাসাকার’-ও শাহের পতনে বড় ভূমিকা রাখে। ১৯৭৯ সালের ১৬ই জানুয়ারি মহম্মদ শাহ দেশ ছাড়ার পর আয়াতোল্লাহ আলি খামেনেই এবং রুহুল্লাহ খোমেইনি ক্ষমতায় আসেন।

শাহ মহম্মদ রেজা পহলভির দেশ ছাড়ার পর ছেলে রেজা মিশরে নির্বাসিত হন। ১৯৮০ সালে বাবার মৃত্যুর পর রেজা নিজেকে তাঁর উত্তরাধিকারী ঘোষণা করেন এবং ২১ বছর বয়সে নিজেকে ইরানের রাজা ঘোষণা করেন। তবে সে সময় আমেরিকা নতুন ইরানি সরকারের প্রতিই সমর্থন জানায়।

দীর্ঘ নির্বাসন ও বর্তমান প্রচেষ্টা:

পরবর্তীকালে, ১৯৮২ সালে ইসরায়েলি ব্যবসায়ী ও গুপ্তচর ইয়াকভ নিমরোদি রেজার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন এবং জানান যে, রেজা ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা অ্যাডল্ফ উইলিয়াম সুইমার এবং সৌদি আরবের ধনকুবের আদনান খাশোগির সঙ্গে মিলে ইরানে সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছিলেন। আমেরিকান গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ এবং ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার সমর্থন পেলেও, তৎকালীন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী মেনাখেম বেজিনের পদত্যাগের পর রেজার পাশ থেকে সবাই সরে যায়।

তবে গত কয়েক দশকে রেজা বিদেশে নিজের গ্রহণযোগ্যতা গড়ে তুলতে পেরেছেন, বিশেষ করে প্রবাসী ইরানিদের সমর্থন কুড়োতে অনেকটাই সফল হয়েছেন তিনি। নিজের ওয়েবসাইটে রেজা দাবি করেছেন, তিনি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ইরান গড়ে তুলতে চান, যেখানে মানবাধিকার সর্বোচ্চ সম্মান পাবে। ইরানে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র থাকবে নাকি প্রজাতন্ত্র গড়ে উঠবে, তা ইরানের সাধারণ মানুষের হাতেই ছেড়েছেন তিনি।

২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে তেহরানে অশান্তি ছড়ালে এবং ২০১৮ সালে তিনি ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসি-তে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। ২০২৩ সালে ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পস-কে নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেন এবং ব্রিটেন ও ইউরোপীয় সরকারগুলির দ্বারস্থ হন। ২০২৩ সালে স্ত্রী ইয়াসমিনের সঙ্গে তিনি ইসরায়েল পৌঁছলে শোরগোল পড়ে যায়। মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর রেজার সমর্থনে ৪ লক্ষ ৬০ হাজার স্বাক্ষর জমা পড়েছিল।

ভবিষ্যৎ কি অনিশ্চিত?

তবে রেজার হাতে ইরানের শাসনব্যবস্থা তুলে দেওয়া নিয়ে কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। অনেকেই মনে করেন, রেজা যতটা না রাজনীতিক, তার চেয়ে বেশি একটি ধারার প্রতীক। ইরানের সাধারণ মানুষের মধ্যে রেজাকে নিয়ে তেমন আবেগ বা সমর্থন এখনো দেখা যায় না এবং তিনি তৃণমূলস্তরের মানুষের মনে দাগ কাটতে পারেননি বলেও মত অনেকের। যদিও ২০২৪ সালের আমেরিকান রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমীক্ষায় দেখা যায়, খামেনেইয়ের পরিবর্তে ইরানের ৮০ শতাংশ মানুষ রেজাকে মেনে নিতে রাজি।

সম্প্রতি আমেরিকা ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র গবেষণা কেন্দ্রে হামলা চালালে রেজা জানান, এই যুদ্ধ খামেনেইয়ের যুদ্ধ, কিন্তু ইরানের সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের মাশুল গুনতে হচ্ছে। ইসলামিক ইরানের পতন অবশ্যম্ভাবী বলেও গত ১৭ জুন ঘোষণা করেন রেজা। দেশের সেনাবাহিনীকেও খামেনেইর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে আহ্বান জানিয়েছেন।

তবে শেষ পর্যন্ত রেজা কতটা সফল হন, তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। কারণ দেশের সাধারণ মানুষ সরকারি নীতি-নিয়ম এবং রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে সরব হলেও, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ কতটা মেনে নেবেন, তা নিয়ে ধন্দ রয়েছে। সাম্প্রতিক সংঘাতপর্বে কিছু জায়গায় বিক্ষোভ চোখে পড়লেও, পশ্চিমা আগ্রাসনের প্রতি খুব বেশি সমর্থন চোখে পড়েনি।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy