
৬০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা একটি কুখ্যাত কারাগারকে পুনরায় চালু করার নির্দেশ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুধু চালু করাই নয়, এটিকে আরও বড় করে সম্প্রসারণ করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সানফ্রান্সিসকোর কাছে অবস্থিত দুর্গম দ্বীপ আলকাট্রাজে এই বন্দিশালাটি ১৯৩৪ সালে স্থাপন করা হয়েছিল এবং আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক অপরাধীদের রাখার জন্য কুখ্যাতি লাভ করেছিল। পরে ১৯৬৩ সালে এটিকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এই আকস্মিক নির্দেশ ঘিরে আমেরিকা জুড়ে এবং আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র চাঞ্চল্য ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প গত রবিবার (৪ মে) তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘ট্রুথ সোস্যালে’ একটি পোস্টে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরে ফ্লোরিডা থেকে হোয়াইট হাউসে ফেরার পর সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও তিনি একই কথা বলেন। ট্রাম্প দাবি করেন, আমেরিকার জনগণ দীর্ঘদিন ধরে হিংস্র এবং সহিংস অপরাধীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশেষ করে কিছু অপরাধী বারবার সহিংস কার্যকলাপ করে চলেছে। তিনি বলেন, একসময় আলকাট্রাজ ছিল আমেরিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক অপরাধীদের রাখার জায়গা, যা আমেরিকানদের রক্ষায় সহায়ক ছিল। ট্রাম্প ঘোষণা করেন, তিনি বিচার বিভাগ, ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই) এবং হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সঙ্গে কারাগার ব্যুরোকে একত্রিত করে আলকাট্রাজ কারাগারটিকে পুনরায় চালু ও সম্প্রসারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানে আমেরিকার সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও সহিংস অপরাধীদের রাখা হবে। ট্রাম্পের মতে, কারাগারটির একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে এবং এটি আইন ও শৃঙ্খলার প্রতীক।
সান ফ্রান্সিসকো উপসাগরে অবস্থিত এই কুখ্যাত কারাগারটি ১৯৬৩ সাল থেকে বন্ধ ছিল, অর্থাৎ দীর্ঘ ৬৩ বছর ধরে এটি নিষ্ক্রিয় ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অফ প্রিজনসের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, কারাগারটির অবকাঠামো অত্যন্ত ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছিল এবং পরিচালনার খরচ ছিল আকাশছোঁয়া। দ্বীপের উপর অবস্থিত হওয়ায় অন্য যেকোনো ফেডারেল কারাগারের তুলনায় এর রক্ষণাবেক্ষণের খরচ প্রায় তিনগুণ বেশি ছিল। এই কারণেই ১৯৬৩ সালে এটি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর পরিচালনা ব্যয় ছিল বন্ধ করে দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ।
তবে এই সমস্ত কিছু সত্ত্বেও আলকাট্রাজকে একসময় আমেরিকার সবচেয়ে নিরাপদ কারাগার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এর কারণ ছিল দ্বীপের দুর্গম অবস্থান, চারপাশের উপসাগরের তীব্র স্রোত এবং বরফ শীতল পানি। আনুষ্ঠানিকভাবে এই কারাগার থেকে কোনো বন্দির পালানোর রেকর্ড নেই। এফবিআইয়ের তথ্যমতে, কারাগারটি চালু থাকাকালীন ৩৬ জন আসামি অন্তত ১৪ বার পালানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কেউই সফল হননি। পালানোর চেষ্টা করা সবাই শেষ পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়েছিলেন।
বর্তমানে আলকাট্রাজ কারাগারটি সান ফ্রান্সিসকোর অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে পরিচিত। এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় উদ্যানও বটে। ট্রাম্পের এই ঘোষণার পর থেকেই আমেরিকা জুড়ে এবং আন্তর্জাতিক মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তে তীব্র দ্বিমত পোষণ করেছেন সাবেক হাউস স্পিকার এবং ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্র্যাটিক আইনপ্রণেতা ন্যান্সি পেলোসি। তিনি তাঁর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (পূর্বে টুইটার) একটি পোস্টে বলেছেন, “৬০ বছরেরও বেশি আগে আলকাট্রাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। এটি এখন একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় জাতীয় উদ্যান এবং প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।” তিনি ট্রাম্পের প্রস্তাবটিকে “যথোচিত নয়” বা অনুচিত বলে মন্তব্য করেছেন।
আলকাট্রাজের একটি দীর্ঘ এবং বৈচিত্রময় ইতিহাস রয়েছে। শুরুতে এটি একটি নৌ প্রতিরক্ষা দুর্গ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ২০ শতকের প্রথম দিকে এটিকে একটি সামরিক কারাগারে রূপান্তরিত করা হয়। ১৯৩০-এর দশকে এটিকে বিচার বিভাগের অধীনে নিয়ে আসা হয় এবং এরপর থেকে ফেডারেল বন্দীদের এখানে পাঠানো শুরু করা হয়। এখানে রাখা কুখ্যাত কয়েদিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বিখ্যাত গ্যাংস্টার আল কাপোন, মিকি কোহেন এবং জর্জ ‘মেশিন গান’ কেলি। হলিউডের চলচ্চিত্রেও আলকাট্রাজ বিখ্যাত হয়েছে। ১৯৬২ সালে বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার অভিনীত ‘বার্ডম্যান অফ আলকাট্রাজ’ এবং ১৯৯৬ সালের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘দ্য রক’ (শন কনারি ও নিকোলাস কেজ অভিনীত) এই দ্বীপেই চিত্রায়িত হয়েছিল।
একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণকে পুনরায় কুখ্যাত বন্দিশালায় রূপান্তরিত করার ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আমেরিকা জুড়ে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র: ইউএনবি