
মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের ব্যবসায়ী পরিবার রঘুবংশীর কনিষ্ঠ পুত্র রাজা রঘুবংশীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর আজ উজ্জয়িনীতে শিপ্রা নদীর তীরে তার পিণ্ডদান সম্পন্ন হলো। ২ জুন মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির ওয়েইসাওডং জলপ্রপাতের কাছে রাজার ক্ষতবিক্ষত ও পচাগলা মৃতদেহ উদ্ধারের ১১ দিন পর এই লৌকিকতা সম্পন্ন হলো। হানিমুনের নামে মেঘালয়ে নিয়ে গিয়ে রাজাকে নৃশংসভাবে খুন করার অভিযোগে তার স্ত্রী সোনম এবং সোনমের প্রেমিক রাজ কুশওয়াহা সহ রাজের তিন বাল্যবন্ধুকে ইতিমধ্যেই গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মেঘালয় পুলিশ জানিয়েছে, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের জেরেই সোনম ও তার প্রেমিক রাজ কুশওয়াহা মিলে রাজাকে খুনের ষড়যন্ত্র করে। এই সম্পর্কের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটে।
পিণ্ডদান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সোনমের ভাই গোবিন্দ রঘুবংশী। বোনের এমন জঘন্যতম অপরাধে তিনি নিজেও লজ্জিত ও ব্যথিত। সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি বলেন, “রাজের সঙ্গে সোনমের সম্পর্কের কথা আমি আগে জানলে ওদের বিয়ে দিতাম। তাতে মা-বাবা আপত্তি করলে সোনমকে বলতাম, রাজকে নিয়ে তুই পালিয়ে যা। তা হলে রাজার এই করুণ পরিণতি হতো না। ও বেঁচে যেত। সোনমের ওই সম্পর্কে কথা জানলে রাজার সঙ্গে কখনওই ওর বিয়ে আমি হতে দিতাম না।”
তিনি আরও বলেন, “সোনমকে তো আমরা কখনও রাজাকে বিয়ে করার জন্য জোর করিনি। বিয়ে করতে না–চাইলে সেটা ও বলতেই পারত। যেটা ও করল, তার কোনও ক্ষমা হয় না। তার জন্য শুধু আমাদের পরিবার নয়, কেবল ইন্দোর নয়, গোটা মধ্যপ্রদেশ রাজ্যেরই লজ্জার শেষ নেই।” নিজের বোন সোনমকে গোবিন্দ ‘একগুঁয়ে, জেদি ও বদমেজাজি’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার মতে, “বিচারে দোষ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ডই সোনমের প্রাপ্য।”
তদন্তের মাঝেই রাজের সঙ্গে সোনমের দু’বছর আগের, অর্থাৎ ২০২৩ সালের একটি ছবি (যার সত্যতা ‘এই সময়’ যাচাই করেনি) সামনে এসেছে। তদন্তকারীদের বক্তব্য, এই ছবি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সোনমদের পারিবারিক কারখানার বিলিং ডিপার্টমেন্টে রাজ কুশওয়াহা নিছকই একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিল না। মালকিন-কর্মচারী সম্পর্কের চেয়ে তাদের মধ্যে আরও গভীর সম্পর্ক ছিল। ছবিতে সোনমকে হাসতে দেখা যাচ্ছে, আর রাজের কপালে লাল তিলক এবং মুখে খুশির ঝলক। রাজের কাঁধে একজনের হাত দেখা যাচ্ছে। পুলিশের একাংশ মনে করছেন, এই ছবি সোনম ও রাজের সম্পর্ক অন্তত দু’বছরের পুরোনো হওয়ার প্রমাণ এবং রাজাকে হত্যায় দু’জনের যৌথ ষড়যন্ত্রেরও ইঙ্গিত দেয়।
মেঘালয় পুলিশ সূত্রে খবর, চেরাপুঞ্জিতে রাজাকে খুন করে ইন্দোরে ফিরে আসার পর সোনম ওই শহরের দেওয়াস নাকা এলাকার কাছে হিরা বাগ কলোনিতে বিশাল সিং চৌহানের ভাড়া নেওয়া একটি ফ্ল্যাটে লুকিয়ে ছিলেন। সদ্য তৈরি হওয়া একটি তিনতলা বাড়ির একতলার ওই ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ১৭ হাজার টাকা, এবং সিকিউরিটি ডিপোজিট বাবদ ৫১ হাজার টাকাও ফ্ল্যাটের মালিককে দেওয়া হয়েছিল।
রাজের তিন বন্ধুর অন্যতম এই বিশাল, যাকে রাজা খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, ওয়েইসাওডং জলপ্রপাত দেখতে যাওয়ার খাড়াই রাস্তায় ওঠার সময়ে সোনম নির্দেশ দেওয়া মাত্র বিকাশ নামের আরেক বন্ধু প্রথম রাজার মাথার সামনে ও পিছনে কাটারি দিয়ে কোপ মেরেছিল। এরপর রাজাকে আক্রমণ করে আকাশ রাজপুত ও আনন্দ কুরমি।
জানা গিয়েছে, ইন্দোরে বিশালের বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের ওই ফ্ল্যাটটি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল ৩০ মে, অর্থাৎ রাজাকে খুন করার এক সপ্তাহ পরে। মেঘালয় পুলিশ সূত্রে আরও জানা গেছে, ফ্ল্যাট ভাড়া নেওয়ার সময়ে পুলিশ ভেরিফিকেশনও হয়েছিল এবং সেই সময়ে বিশাল নিজেকে একজন ইন্টিরিয়র ডিজাইনার হিসেবে পরিচয় দেয়। সোনম ওই ফ্ল্যাটে থাকার সময়ে তার জন্য খাবার-দাবার এবং গৃহস্থালির কিছু সরঞ্জাম মিলিয়ে রাজ মোট পাঁচ হাজার টাকার সামগ্রী অনলাইনে কিনেছিল। সোনম ওই ফ্ল্যাটে ছিল মোট ৯ দিন।
উজ্জয়িনীতে রাজার পিণ্ডদান অনুষ্ঠানে গোবিন্দ রঘুবংশী রাজার পরিবারের সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, “রাজা তো ছিল আমার ভাইয়ের মতো। এটা আমার ভাইয়ের পরিবার।” রাজার দাদা বিপিন রঘুবংশী এই বিষয়ে বলেন, “গোবিন্দকে আমরা জানিয়েছিলাম যে, রাজার পিণ্ডদানে ও আসতেই পারে। দোষটা ওর বোন করেছে, ও তো করেনি।”
এই ঘটনা কেবল একটি হত্যাকাণ্ডের চেয়েও বেশি কিছু, এটি সম্পর্কের টানাপোড়েন, বিশ্বাসঘাতকতা এবং এক ভয়াবহ অপরাধের চিত্র তুলে ধরছে, যা গোটা মধ্যপ্রদেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।