‘আইলা’ থেকে ‘অশনি’, মে মাসেই কেন ঝড় হয়? জেনেনিন সেই বিশেষ কারণ

আন্দামান সাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’ এখন বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। অন্যদিকে ভারত মহাসাগরে আরো একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়েছে। এটিও ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছে ভারতের আবহাওয়া অধিদফতর।
এদিকে, চলছে মে মাস। মে মাসেই অনেকগুলো বড় আকারের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। সেসব দিক বিবেচনায়, মে মাসটাই উপকূলবাসির কাছে যেন ঝড় প্রবণ মাস। তাইতো সকল চিন্তা যেন দুশ্চিন্তায় রূপ নিয়েছে উপকূলের মানুষের।

আজ ইতিকথার স্মৃতিচারণ হোক মে মাসে হওয়া কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় নিয়ে।

আইলা

২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত করেছিল বাংলাদেশে। আইলা জন্ম নেয় ২১ মে, ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার (৫৯০ মাইল) দক্ষিণে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে ঘুর্ণিঝড়টি আঘাত হানে ২৫ মে।

ঘূর্ণিঝড় আইলার ব্যাস ছিল প্রায় ৩০০ কিলোমিটার, যা ঘূর্ণিঝড় সিডর থেকে ৫০ কিলোমিটার বেশি। এটি ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে। পরে বাতাসের বেগ কমে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি সিডরের তুলনায় কম হয়েছে। বাংলাদেশে আইলা পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া, নিঝুম দ্বীপ, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। আইলার প্রভাবে খুলনা ও সাতক্ষীরায় ৭১১ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়েছে। এই দুই অঞ্চলে প্রাণ হারিয়েছে মোট ১৯৩ জন।

ঘূর্ণিঝড় আইলার এক বছর পর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা যায়, আইলায় প্রায় দুই লাখ একর কৃষিজমি নোনা জলে তলিয়ে যায়। আক্রান্ত এলাকাগুলোয় পানীয় জলের উৎস সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়। দুই লাখ ৪৩ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। পর পর দুই মৌসুম কৃষিকাজ না হওয়ায় প্রায় আট লাখ টন খাদ্যঘাটতি সৃষ্টি হয়; এমনকি সুন্দরবন অঞ্চলে বাংলার ২৬৫টি বাঘের আশ্রয় বিপন্ন হয়ে যায়। আইলার প্রভাবে নিঝুম দ্বীপ এলাকার সব পুকুরের জলও লবণাক্ত হয়ে পড়েছিল।

ঘূর্ণিঝড় মহাসেন

ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’ ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানে৷ এটির বাতাসের গতি ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার৷ এই ঝড় বাংলাদেশে ১৭ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়৷

ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু

রোয়ানু একটি ছোট ঘূর্নিঝড়, যা ২০১৬ সালে ২১ মে বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে এবং ভারতে আংশিক অঞ্চলে আঘাত হানে৷ ধারণা করা হয়, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর ব্যাপ্তি ছিল দুটি বাংলাদেশের সমান আকৃতির৷ রোয়ানু-র আঘাতে চট্টগ্রামে ২৬ জনের মৃত্যু হয়৷

ঘূর্ণিঝড় মোরা

উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোরা ২০১৭ সালের ৩০ মে ১৪৬ কিলোমিটার বাতাসের গতিতে কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে৷ ঝড়ের তাণ্ডবে হাজার হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়৷ কক্সবাজারে বিদ্যুৎব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ জমির ফসল এবং লবন চাষীদের জমাকৃত লবন নষ্ট হয়ে যায়৷ দুজন নারীসহ তিনজন মারা যায়৷

ঘূর্ণিঝড় ফণী

২০১৯ সালের ৩ মে বঙ্গপোসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে নয় জনের মৃত্যু হয়৷ তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমান ছিল অনেক বেশি৷ সরকারি হিসেব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়৷

ইয়াস

২০২১ সালের ২৬শে মে আঘাত করেছিল ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। এর প্রভাবে বাংলাদেশের ১৫টি জেলার ৭৭টি উপজেলা ও ১৩টি পৌরসভায় ক্ষয়ক্ষতি হয়, মৃত্যু হয় ৭ জনের।

২০২১ সালের মে মাসের শেষ দিকে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন একটি শক্তিশালী ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় ছিল ইয়াস। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস একটি ক্রান্তীয় নিম্নচাপ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, যা ২৩ মে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ প্রথম পর্যবেক্ষণ করে। ২৪ মে, ভারতের পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রামের নিম্ন-অঞ্চলগুলো থেকে লোকজন সরিয়ে নিতে আদেশ দেওয়া হয়।

ইয়াসের প্রভাবে যখন জোয়ারের উচ্চতা বেড়েছিল, তখন দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় জনগণকে বাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে নামতে দেখা গিয়েছিল। শেষ অবধি ২৬শে মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস।

অশনির ভয়

প্রবল ঘূর্ণিঝড় অশনি’র কেন্দ্রে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠে যাচ্ছে ১১৭ কিলোমিটার। বর্তমানে এটি ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে উপকূলের দিকে এগোচ্ছে।

আবহাওয়াবিদের ধারনা, একদিকে যেমন অশনি জলীয় বাষ্প টানবে আন্দামান সাগর থেকে, অন্যদিকে নতুন নিম্নচাপটি জলীয় বাষ্প টানবে ভারত মহাসাগর থেকে। দুটির মধ্যে বিস্তর টানাটানি হবে। ফলে একদিকে যেমন বায়ুপ্রবাহ পাক খাবে ঘড়ির কাঁটার দিকে, তেমনি অন্যদিকে তা ঘুরবে ঘড়ির কাঁটার বিপরীতেও। যে বেশি বাতাস টানবে তারই শক্তি বৃদ্ধি পাবে।

অধিকাংশ ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে মে মাসেই৷ মে মাসে কেন ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতা এত বেশি?

মে মাসে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার একাধিক কারণ খুঁজে পেয়েছেন আবহবিদরা৷ আবহবিদরা জানাচ্ছেন, প্রাক বর্ষার মৌসুমই (এপ্রিল এবং মে মাস) ঘূর্ণিঝড়ের উপযুক্ত সময়। এর মধ্যে মে মাসে ঘূর্ণিঝড় সবথেকে বেশি হয়। মে মাসে বঙ্গোপসাগরে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বেশ কয়েকটি কারণে উপরে এই ঘূর্ণিঝড় নির্ভর করে।

সেগুলো হলো-

১) সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা অন্যতম কারণ। সাধারণত ২৬ ডিগ্রি ন্যূনতম তাপমাত্রা থাকলেই ঘূর্ণিঝড়ের উপযুক্ত হয় সাগর। বর্তমানে যেমন ৩০ ডিগ্রি তাপমাত্রা রয়েছে বঙ্গোপসাগরে।

২) বাতাসের ওপরের দিকে উঠতে পারে এরকম অনুকূল পরিস্থিতি থাকলে তবেই ঘূর্ণিঝড় হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। যখন গরম কালে হিট ওয়েভ চলতে থাকে তখন বাতাসের ওপর থেকে নিচের দিকে আসে। তাই ঘূর্ণিঝড় হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

৩) অনুঘটক- পূবালী হাওয়া অথবা নিম্নচাপ। কোনো ঘূর্ণাবর্ত থাকলেও তা ঘূর্ণিঝড় তৈরিতে সাহায্য করে। হঠাৎ সমুদ্রপৃষ্ঠে এরকম কোনো সিস্টেম তৈরি হওয়া যা ঘূর্ণিঝড়ের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে।

৪) বঙ্গোপসাগরের ওপরে এসে অনেক দুর্বল ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপও পুনরায় সজীব হয়ে ওঠে। বিভিন্ন মহাসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের উপরে পৌঁছে কোনো ঘূর্ণাবর্ত বা নিম্নচাপ ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়েছে, এরকম উদাহরণ রয়েছে।

৫) প্রাক বর্ষার সময়ে এপ্রিল ও মে মাসে যেমন ঘূর্ণিঝড় হওয়ার প্রবণতা বেশি, তেমনই অক্টোবর-নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকে। তবে মে মাসে ঘূর্ণিঝড় হওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ অনেকটাই বেশি হয়।

যেভাবে সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড়

সাধারণত নিম্নচাপ থেকে জন্ম হয় ঘূর্ণিঝড়ের। নিরক্ষীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা যদি বেড়ে যায় তাহলে উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাস হালকা হয়ে উপরে উঠে যায়। ফলে একটা শূন্যস্থান তৈরি হয়। সেই খালি জায়গা ভরাট করতে তখন মেরু অঞ্চল থেকে ঠান্ডা বাতাস নিরক্ষরেখার দিকে ছুটে আসে। কিন্তু এই বাতাস সোজাসুজি প্রবাহিত হয় না। পৃথিবী তার নিজের অক্ষের চারদিকে ঘোরে বলে একরকম শক্তি তৈরি হয়, যার ফলে এই বাতাস উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণে ও দক্ষিণ গোলার্ধের উত্তরে বেঁকে যায়। প্রবল বেগে বইতে থাকা এই বাতাস ঘূর্ণি তৈরি করে, যাকে আমরা ঘূর্ণিঝড় বলি।

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy