অম্বুবাচীতে লাল হয়ে যায় ব্রহ্মপুত্রের জলও, কেন? জেনেনিন ধর্মীয় বিশ্বাস ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা

প্রতি বছর আষাঢ় মাসে অম্বুবাচীর সময় গুয়াহাটির কামাখ্যা মন্দিরের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের জল রক্তিম বর্ণ ধারণ করে, যা লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও কৌতূহলী মানুষের কাছে এক অলৌকিক ঘটনার প্রতীক। এই সময়ে ব্রহ্মপুত্রের জল কেন লাল হয়ে যায়, তা নিয়ে প্রচলিত আছে গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস এবং একই সাথে রয়েছে কিছু বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও।

হিন্দু পুরাণ ও তন্ত্র মতে, আসামের নীলাচল পাহাড়ে অবস্থিত কামাখ্যা মন্দির ৫১ পীঠের অন্যতম এবং এটি দেবী সতীর যোনি পীঠ হিসাবে পরিচিত। বিশ্বাস করা হয়, প্রতি বছর অম্বুবাচীর সময় (সাধারণত জুন মাসের মাঝামাঝি) মা কামাখ্যা ঋতুমতী হন। এই সময়টায় দেবীর বার্ষিক ঋতুস্রাব হয় এবং সেই কারণে মন্দিরের গর্ভগৃহের একটি প্রাকৃতিক ঝর্ণার জল লাল হয়ে যায়। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সেই লাল জলই ব্রহ্মপুত্র নদে মিশে গিয়ে তার রঙ পরিবর্তন করে দেয়।

অম্বুবাচী মেলা মূলত এই উর্বরতা এবং নারীশক্তির উদযাপন। এই তিন দিন ধরে কামাখ্যা মন্দিরের দ্বার বন্ধ থাকে, যা দেবীর বিশ্রামের সময় হিসাবে বিবেচিত। এই সময়ে কোনো পূজা, কৃষিকাজ বা শুভ কাজ করা হয় না। অম্বুবাচী শেষে মন্দিরের দ্বার পুনরায় উন্মোচিত হলে ভক্তদের মধ্যে লাল কাপড় (অঙ্গবস্ত্র) এবং লাল জল (অঙ্গোদক) প্রসাদ হিসাবে বিতরণ করা হয়, যা অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করা হয়।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা: মাটি ও খনিজ পদার্থের প্রভাব

যদিও ধর্মপ্রাণ ভক্তরা একে দেবীর অলৌকিক ক্রিয়া হিসেবেই দেখেন, কিছু বৈজ্ঞানিক ও স্থানীয় পর্যবেক্ষক এই ঘটনার পেছনে প্রাকৃতিক কারণ থাকার কথা উল্লেখ করেন:

আয়রন সমৃদ্ধ মাটি: আসামের মাটি প্রাকৃতিকভাবেই আয়রন (লৌহ) সমৃদ্ধ। বর্ষার শুরুতে ব্রহ্মপুত্রের জলস্তর বৃদ্ধি পেলে এবং নদীর ভাঙন শুরু হলে এই আয়রন সমৃদ্ধ মাটি নদীর জলের সঙ্গে মিশে যায়। আয়রনের অক্সিডেশন প্রক্রিয়ার কারণে জলের রঙ লালচে বা রক্তিম দেখায়। আসামের ট্যাপের জলেও প্রায়শই এই আয়রনের কারণে লালচে আভা দেখা যায়, যা এই যুক্তির সমর্থন করে।

সিনাবার (Cinnabar) উপস্থিতি: কিছু গবেষক মনে করেন, কামাখ্যা মন্দিরের আশেপাশে পাহাড়ে সিনাবার (Cinnabar) বা মার্কারি সালফাইড নামক খনিজ পদার্থের বড়সড় সঞ্চয় থাকতে পারে, যার রঙ লাল। বৃষ্টির জলের সাথে এই খনিজ পদার্থ মিশে নদীর জলকে রক্তিম করে তুলতে পারে।

যদিও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলি এই রঙের পরিবর্তনকে আংশিকভাবে বোঝাতে পারে, তবে অম্বুবাচীর নির্দিষ্ট দিনগুলিতেই কেন এমন ঘটে, এবং এই ঘটনার সঙ্গে ধর্মীয় আচারের গভীর সংযোগের রহস্য আজও বহু মানুষের কাছে অলৌকিকতা ও বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে। এই মিলনক্ষেত্রেই অম্বুবাচী ব্রহ্মপুত্রের জলকে এক রহস্যময় লালিমায় রাঙিয়ে তোলে, যা বিশ্বাস ও বিজ্ঞান উভয়কেই এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবতে শেখায়।

Related Posts

© 2025 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy