বিশেষ: ২২২ বছর আগে প্রথম ব্যাটারির ধারণা আসে এই মাছ থেকে! জেনেনিন মাছটির পরিচয়

বেশিরভাগ ইল কমবেশি ৬৫০ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। অন্যদিকে, একটি একক লিথিয়াম-আয়নের সর্বোচ্চ ভোল্টেজ ৪.২।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে বিশ্বে পোর্টেবল এনার্জি অর্থাৎ ব্যাটারির প্রয়োজনও বাড়ছে। ইতালীর পদার্থবিজ্ঞানী আলেসান্দ্রো ভোল্টা ১৮০০ সালে প্রথম ব্যাটারি আবিষ্কার করেন। এটি তৈরিতে মৌলিক বৈদ্যুতিক রাসায়নিক নীতি (ইলেকট্রনের প্রবাহ) ব্যবহার করেছিলেন তিনি।

কিন্তু, ব্যাটারি তৈরির অনুপ্রেরণা তিনি পান কোথা থেকে?

টিমোথি জর্গেনসেন তার বই স্পার্ক: দ্য লাইফ অফ ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড দ্য ইলেক্ট্রিসিটি অফ লাইফ-এ উল্লেখ করেন, বৈদ্যুতিক ইল মাছ থেকেই ব্যাটারি তৈরির অনুপ্রেরণা পান ভোল্টা।

এমনকি বর্তমানে ব্যাটারি নিয়ে কাজ করা গবেষকরা এটিকে আরও উন্নতকরণের ধারণা পাওয়ার জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী এই প্রাণীগুলোকেই পরীক্ষানিরীক্ষা করেন।

বৈদ্যুতিক মাছের অনুপ্রেরণায় তৈরি ব্যাটারি

ভোল্টারের তৈরি ব্যাটারির আগে মানুষ বিভিন্ন উপকরণ একসঙ্গে ঘষে, সাধারণত কাচের উপর সিল্ক ঘষে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারতো। কিন্তু, তা ব্যবহার করার কোনো মাধ্যম ছিল না সেসময়।

ভোল্টা জানতেন যে, বৈদ্যুতিক মাছগুলোর একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ রয়েছে যা বিশেষভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। তিনি যুক্তি দেন, যদি এই অঙ্গের কার্যকারিতা অনুকরণ করা যায় তাহলে তিনি বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি অভিনব উপায় খুঁজে বের করতে পারবেন।

ইলের বৈদ্যুতিক অঙ্গটি মূলত কোষের একটি দীর্ঘ স্তুপ, দেখতে অনেকটা মুদ্রার রোলের মতো। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য, ভোল্টা তাই বিভিন্ন ধাতব উপকরণের শীট থেকে মুদ্রার মতো করে কিছু অংশ কাটেন। সেগুলোকে বিভিন্ন ক্রমানুসারে স্তুপ আকারে রেখে তিনি এমন ধাতুর সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা করেন যা বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে।

অবশেষে, দস্তার সাথে তামার ডিস্ক জোড়া দেওয়ার মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম হন তিনি। দস্তা-তামার সেই জোড়ার মাঝে লবণাক্ত পানিতে ভেজানো কাগজের ডিস্ক বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করেন তিনি।

ভোল্টা ভেবেছিলেন, ইল কিভাবে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে তার রহস্য তিনি উন্মোচন করে ফেলেছেন। প্রাথমিকভাবে এই আবিষ্কারটিকে তিনি ‘আর্টিফিসিয়াল ইলেকট্রিক অর্গান’ বা কৃত্রিম বৈদ্যুতিক অঙ্গ বলে অভিহিত করেন। কিন্তু, আসলে তিনি ইলের রহস্যভেদ করতে পারেন নি।

ব্যাটারি তৈরির জন্য প্রথম উপকরণ তামা ও দস্তা হলেও, পরবর্তীতে উন্নতমানের ব্যাটারি তৈরিতে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম। বর্তমানের ব্যাটারিগুলো বিজ্ঞানী ভোল্টার আবিষ্কৃত ব্যাটারি থেকে অনেক বেশি

উন্নতমানের হলেও এগুলো তার প্রাথমিক কৌশলই অনুসরণ করে তৈরি।

ইলেক্ট্রিফায়িং ইফেক্ট বা বিদ্যুতায়ন প্রভাব

বিজ্ঞানীরা এখন জানেন যে, বৈদ্যুতিক ইলের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে ভোল্টার আবিষ্কৃত বৈদ্যুতিক রাসায়নিক বিক্রিয়াগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। বরং, আমাদের স্নায়ু কোষগুলো যেভাবে বৈদ্যুতিক সংকেত তৈরি করে কাজ করে, সেই সংকেতের অনুরূপ পদ্ধতি ব্যবহার করে ইল।

ইলের বৈদ্যুতিক অঙ্গটি একটি অর্ধভেদ্য ঝিল্লি বা পর্দা দিয়ে আবৃত। এই অঙ্গে থাকা বিশেষ কোষগুলো পর্দার একপাশ থেকে আরেক পাশে ভিন্ন চার্জযুক্ত রাসায়নিক আয়ন আদান-প্রদানে সক্ষম। এই প্রক্রিয়াতেই ইলের দেহে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।

আক্রমণের আগে বৈদ্যুতিক ইল তার শিকারকে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে দুর্বল করে ফেলে; কিন্তু বিদ্যুৎ প্রয়োগ করে শিকারি মারতে সক্ষম নয় এই মাছ।

একটি ইল শত শত ভোল্ট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম হলেও সেই ভোল্টেজ যথেষ্ট কারেন্ট (অ্যাম্পেরেজ) তৈরি করতে পারেনা। একটি মাছ থেকে আসা প্রতিটি বৈদ্যুতিক পালস ১ সেকেন্ডের মাত্র কয়েক হাজার ভাগ সময়জুড়ে স্থায়ী হয় এবং এর পরিমাণ ১ অ্যাম্পিয়ারেরও কম।

এই একই প্রক্রিয়ায় বর্তমানের বৈদ্যুতিক বেড়া কাজ করে। উচ্চ-ভোল্টেজ বিদ্যুতের খুব সংক্ষিপ্ত পালস চলাচল করে এই বেড়াগুলোতে, পাশাপাশি এগুলোর অ্যাম্পেরেজও থাকে কম। ফলে কোনো প্রাণী বেড়া পার হতে গেলে সে কেবল শক খাবে, তার মৃত্যু হবে না।

আধুনিক প্রচেষ্টা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সুইজারল্যান্ডের বিজ্ঞানীদের একটি দল বর্তমানে ইল অনুপ্রাণিত এক নতুন ধরনের ব্যাটারি নিয়ে কাজ করছে। তাদের মতে, এসব নরম ও নমনীয় ব্যাটারি ভবিষ্যতে মেডিকেল ইমপ্লান্টে অভ্যন্তরীণভাবে শক্তি যোগানোর ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে।

তবে, সেই পর্যন্ত যেতে তাদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে বলেও জানিয়েছে দলটি।

দলের একজন সদস্য, মাইকেল মায়ার বলেন, “ঈলের বৈদ্যুতিক অঙ্গগুলো অবিশ্বাস্যভাবে পরিশীলিত। তারা আমাদের চেয়ে শক্তি উৎপাদনে অনেক উন্নত।”

২০১৯ সালে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তৈরির জন্য জন গুডেনাফ, এম স্ট্যানলি হুইটিংগাম ও আকিরা ইয়োশিনোকে রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। পুরস্কার প্রদানের সময় রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সেস বলে, পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীদের এই আবিষ্কার ‘একটি ওয়্যারলেস ও জীবাশ্ম জ্বালানি-মুক্ত সমাজের ভিত্তি স্থাপন করেছে’।

‘ওয়্যারলেস’ অংশটি অবশ্যই সত্য। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি এখন মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে কার্যত সব ওয়্যারলেস ডিভাইসকে শক্তি যোগায়।

কিন্তু এটি ‘জীবাশ্ম জ্বালানি-মুক্ত সমাজ’ তৈরি করতে পারেনি। বর্তমানের লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারিগুলো মূলত জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর মাধ্যমে উৎপন্ন বিদ্যুতের মাধ্যমে রিচার্জ হয়।

অন্যদিকে, একই বছর স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞানীরা বৈদ্যুতিক ইলের একটি নতুন দক্ষিণ আমেরিকান প্রজাতির আবিষ্কারের কথা জানান। এটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জৈববিদ্যুৎ জেনারেটর হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

নতুন আবিষ্কৃত প্রজাতির উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ৮৬০ ভোল্ট, যেখানে অন্যান্য প্রজাতির ইল ৬৫০ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। অন্যদিকে, একটি একক লিথিয়াম-আয়নের সর্বোচ্চ ভোল্টেজ ৪.২।

একদিকে যেমন নতুন নতুন বৈদ্যুতিক উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানুষ এগিয়ে চলছে, তেমনি বিবর্তিত হচ্ছে ইলের মতো প্রাণীরাও।

সুত্র- স্ক্রল ডট ইন

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy