গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ আর প্যাচপ্যাচে গরম উপেক্ষা করেও বাংলার মানুষ অসহ্য এই গ্রীষ্মকালের অপেক্ষায় বসে থাকেন। কেন? ফলের রাজা আমের (Mango) দেখা কেবল গ্রীষ্মকালেই মেলে যে! বাঙালির আমপ্রীতি আলাদা করে আর বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষত আম যখন ভারত আর বাংলাদেশের জাতীয় ফল, তখন বাংলা তথা সারা দেশের মানুষের আমের প্রতি টান থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার বছর আগে ভারতের দক্ষিণ অংশ, মায়ানমার এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে প্রথম আমের চাষ শুরু হয়। ভারতবর্ষে সাধারনত ৩০০ টিরও বেশি প্রজাতির আম পাওয়া যায়। প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গে যে আমের চাহিদা দেখা যায়, তার বেশির ভাগটাই পূরণ করে মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা। ল্যাংড়া, ফজলি, হিমসাগর, কতইনা অদ্ভুত নাম মিষ্টি সুস্বাদু এই ফলের। প্রত্যেক নামকরণের পেছনে রয়েছে অদ্ভুত ইতিহাস। আসুন আজ বরং জেনে নেওয়া যাক ভারতের বাজারে প্রাপ্ত প্রধান ২০টি আমের নামকরণের ইতিহাস।
ফজলি : সময়টা তখন ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দের আশেপাশে। মালদহের কালেক্টর র্যাভেন ঘোড়া ছুটিয়ে গৌড়ের দিকে যাচ্ছিলেন। পথে প্রবল জলতেষ্টায় যখন তার প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন এক গ্রাম্য মহিলাকে তিনি নিজের অবস্থার কথা জানিয়ে জল খেতে চান। ওই মহিলা তার বাড়ির আঙ্গিনার আম গাছ থেকে আম পেড়ে সাহেবকে খেতে দেন। সেই গ্রাম্য মহিলার নাম ছিল ফজলু বিবি। সাহেব সন্তুষ্ট হয়ে আমের নামকরণ করেন ফজলি।
ল্যাংড়া : এই আমের নামকরণ হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২ শত বছর আগে। ভারতবর্ষের এক ফকির প্রথম এই প্রজাতির আমের চাষ করতেন তার বাগানে। সেই ফকির পায়ে কিছু সমস্যা ছিল, যে কারণে তিনি খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। ব্যাস, খোড়া ফকিরের নাম থেকেই সুস্বাদু এই আমের নাম হয়ে যায় ল্যাংড়া।
খিরসাপাত : ময়মনসিংহের মহারাজা সুতাংশু কুমার আচার্য্য বাহাদুর চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে একটি বিশাল আমবাগান গড়ে তোলেন। খিরসাপাত আমের চাষ এই আমবাগানেই প্রথম শুরু হয়েছিল।
হিমসাগর : বাংলাদেশ দুই ২৪ পরগনা ও হুগলি জেলায় এই আমের চাষ হয়ে থাকে। আমপ্রেমীদের মধ্যে অনেকেই এই আমকে ফলের রাজা বলে থাকেন।
হাড়িভাঙা : এই আমের নামকরণ নিয়ে একটি বেশ মজার গল্প প্রচলিত আছে। শোনা যায়, মালদার এক কৃষক মাটির হাড়ি দিয়ে ফিল্টার বানিয়ে গাছে জল দিতেন। তার আম গাছে প্রচুর আম ফলতো। আমগুলি ছিল খুব সুস্বাদু। এক রাতে গ্রামের কয়েকজন মানুষ সেই হাড়ি ভেঙে ফেলেন। সেই থেকে ওই আম গাছের নাম হয়ে যায় হাড়িভাঙ্গা।
গোপালভোগ : বাংলাদেশের সর্বত্রই এই আম পাওয়া যায়। স্বাদে-গন্ধে ল্যাংড়া আমের পরেই এই প্রজাতি আমের স্থান।
আলফানসো : পর্তুগীজ এক সামরিক বিশেষজ্ঞ আলফানসু ডি আলবাকারকির নামানুসারে এই আমের নামকরণ করা হয়। ভারত এবং বাংলাদেশেই প্রধানত এই প্রজাতির আমের চাষ হয়ে থাকে।
সুরমা ফজলি : নাটোরের কুরিয়াপাড়া গ্রামে আমজাদ হোসেন নামক এক ব্যক্তি প্রথম সুরমা ফজলি আমের চারা রোপণ করেন। এই আম সম্পর্কে বিশেষভাবে তেমন কেউ জানেন না। তবে আমটি অত্যন্ত সুস্বাদু।
বোম্বাই আম : নামে বোম্বাই আম হলেও বিহারে এর উৎপাদন অনেক বেশি। স্বাদে গন্ধে গোপালভোগ আমের সমান এই প্রজাতির আম।
গৌড়মতি : চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে আশ্বিনা ও ল্যাংড়া জাতের আমের মুকুলের মধ্যে প্রাকৃতিক পরাগায়ন ঘটে এই প্রজাতির আমের উদ্ভব হয়।
আশ্বিনা : গ্রীষ্ম-বর্ষা পেরিয়ে অর্থাৎ আমের সিজন পেরিয়ে যে আম ফলে, নাম তার আশ্বিনা। আশ্বিন মাসে এই আম ফলে বলে আমি নামকরণ করা হয়েছে আশ্বিনা।
আম্রপালি : সাধারনত উন্নত জাতের আম বছরে একবার ফলে। তবে আম্রপালির ক্ষেত্রে সেই নিয়ম খাটে না। নিলাম এবং দশেরি জাতের দুটি আমের সংকরায়ন ঘটিয়ে এই নতুন প্রজাতির আমের উদ্ভব হয়।
চোষা আম : নিজের বাড়ির ছাদে অথবা উঠোনে এই আম গাছ লাগানো যায়। আমের সাইজ অত্যন্ত ছোট। যে কারণে এমন নাম রাখা হয়েছে।
দশেরি : আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ফকির মহম্মদ খান ওরফে গয়া মালিহাবাদির নেতৃত্বে একদল আফ্রিদি পাঠান আফগানিস্তানের সীমান্তে খাইবার গিরিপথের এক গ্রাম থেকে পেশোয়ার হয়ে ভারতে আসে। উত্তরপ্রদেশের ফারুকাবাদের নবাব মহম্মদ খানের বীরত্ব এবং যুদ্ধ বিদ্যায় খুশি হন, বকশিস হিসেবে মহম্মদ খান ফলের বাগান করার অনুমোদন মঞ্জুর করেন। সেই আমের নাম রাখা হয় দশেরি।
মির্জা পসন্দ : নবাব নাজিম ফেরাদুন জাঁ মির্জার পদাধিকারী এক কর্মীর সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। সেই কর্মী আমের বাগান গড়ে তোলেন। ওই কর্মী নিজের আমবাগানের আমের নাম রাখেন মির্জা পসন্দ।
সুবর্ণরেখা : এই আমের রঙ সোনালী রঙের হয়ে থাকে। আমটি দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তাই এই আমের নাম রাখা হয়েছে সুবর্ণরেখা।