সাবধান! বিশ্বের ৪০% মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভালো লাইফস্টাইল’ দেখাতে গিয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়ছেন?

মনে করুন, আজ বৃহস্পতি বার। এই সপ্তাহের পুরোটা কাজ/পড়াশুনা নিয়ে দারুন ধকল গেছে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মনে হচ্ছে এক্ষুনি শুয়ে পড়তে। কালকের পুরো দিনটাও ঘুমানোর প্ল্যান আপনার। কিন্তু হঠাৎ করেই বন্ধুর ফোন এল, তারা সবাই মিলে সিনেমা দেখার ও একসাথে খাওয়ার প্ল্যান করেছে।

যদিও আপনার ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে – কিন্তু আপনি তাকে দু’টি কারণে ’না’ বললেন না। এক, বন্ধুরা আপনার ওপর মাইন্ড করতে পারে; দুই, না গেলে হয়তো দারুন মজা মিস করবেন এবং পরে যখন বন্ধুদের ফেসবুক পোস্ট দেখবেন, এবং এই রাতের গল্প শুনবেন – তখন আপনার খারাপ লাগবে।

বন্ধুদের কাছে নিজের ইমেজ এবং মজা – এই দু’টি জিনিস হারানোর ভয়ে আপনি ভয়ানক ক্লান্ত হওয়ার পরও আপনি গেলেন।

ফলাফল, দরকার মত রেস্ট নিতে না পারায় আপনি পরের সপ্তাহের জন্য রিচার্জ হতে পারলেন না, এবং কাজ/পড়াশুনায় আপনার পারফর্মেন্স খারাপ হল।

অথবা ধরুন, চা-পাতা কিনতে সুপারশপে গেলেন। মাসের শেষে আপনার হাতে বেশি টাকা নেই, ভেবেছিলেন ছোট্ট একটা ১০০ গ্রামের প্যাকেট কিনবেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারলেন, ৫০০ গ্রামের দু’টো প্যাকেট কিনলে ২৫০ গ্রামের একটি ফ্রি পাবেন। প্রয়োজন না থাকার পরও আপনি বাড়তি ২৫০ গ্রামের জন্য ১০০ গ্রামের বদলে ১ কেজি চা পাতা কিনলেন।

ফলাফল, আপনার পকেটের টাকায় টান পড়ল, এবং দেখলেন চায়ের মেয়াদ আছে আর মাত্র এক মাস – এই সময়ে এত চা খেয়ে শেষ করতে পারবেন না। যার ফলে, চা গুলো হয় নষ্ট হবে, অথবা কাউকে দিয়ে দিতে হবে।

কিন্ত কেন আমরা ক্ষতি হবে বা প্রয়োজন নেই জানার পরও কোনওকিছুতে অংশ নেই?

”FOMO” – একটি ফাঁদ
FOMO বা Fear Of Missing Out – টার্মটি সাইকোলজি ও মার্কেটিং এ একটি পরিচিত টার্ম। সোজা বাংলায় এর মানে হল ‘আফসোসের ভয়’। এটা মানুষের একটি সহজাত স্বভাব। মানুষকে এই ফাঁদে ফেলে লেখক থেকে শুরু করে কোম্পানী, সোশ্যাল মিডিয়া – সবাই ব্যবসা করছে।

কোনও কাজ না করলে আপনি কি হারাবেন, অথবা একটি নির্দিষ্ট প্রোডাক্ট না কিনলে কি মিস করবেন – এই ভয়ই মানুষকে অপ্রয়োজনীয় কাজ করতে বা পন্য কিনতে বাধ্য করে।

মানুষ জানে যে একটি লটারির একটি পুরস্কারের বিপরীতে লক্ষ লক্ষ টিকেট ছাড়া হয়। এবং তার জেতার চান্স লক্ষে মাত্র এক। কিন্তু তারপরও মানুষ টিকেট কেনে কারণ তাদের মনে হয় – হয়তো এটা আমার ভাগ্যেই আছে – না কিনলে সুযোগ মিস হয়ে যাবে।

এটি আসলে একটি ফাঁদ। ইন্টারনেট ভিত্তিক মিডিয়া পাবলিকেশন স্লিকনোট এর চিফ মার্কেটিং অফিসার এমিল ক্রিস্টেনসিন বলেন – সীমিত সময়ের জন্য ছাড় বা অন্য লিমিটেড টাইম অফার, অনলাইন কোর্স বা এই ধরনের ডিজিটাল প্রোডাক্টে নির্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্র নেয়ার ঘোষণা, প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের ব্যাপারে অন্য মানুষের পজিটিভ রিভিউ, সেলিব্রিটির সাথে ডিনারের অফার, ভিডিওর থাম্বনেইলে আকর্ষণীয় কিছুর আংশিক ছবি এবং ভিডিওতে ক্লিক করলে পুরোটা দেখানোর প্রতিশ্রুতি – ইত্যাদি মানুষের মাঝে আফসোস বা মিস করার ভয় থেকে কেনার প্রবণতা তৈরী করে।

২০১৩ সালে জুলাইয়ে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার সাইকোলজি, এবং রচেস্টার ইউনিভার্সিটির ক্লিনিক্যাল সোশ্যাল সাইন্স ইন সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট, এবং আরও দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক মিলে “Motivational, emotional, and behavioral correlates of fear of missing out” নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।

গবেষণা পত্রে তাঁরা FOMO কে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “অন্যরা যা পাচ্ছে, তা না পেলে কি হবে, এই নিয়ে দুশ্চিন্তা একজন মানুষকে গ্রাস করার নাম FOMO”

মার্কেটিং এর ভাষায়, “ফমো মার্কেটিং দিয়ে একটি অপ্রয়োজনীয় জিনিসকে ভয়ানক প্রয়োজনীয় হিসেবে মানুষের মনে ধাঁধা তৈরী করা যায়”

FOMO- এর ফাঁদে পড়ার যত ক্ষতি:
বিশেষ করে বাচ্চাদের এটা দারুন ভাবে প্রভাবিত করে। বিজ্ঞাপনে অন্য বাচ্চাদের কিছু খেতে দেখলে, সেটা না কিনে দেয়া পর্যন্ত তারা বাবা-মায়ের ঘুম হারাম করে ফেলে। অন্য দুইজনকে কিছু ব্যবহার করতে দেখলে, নিজের কাছে থাকা ভালো জিনিস বাদ দিয়ে সেটা পেতে ইচ্ছা করে। সেটা পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে।

বড় হলে আমরা এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে শিখি। কারও কাছে ভালো জিনিস দেখলে সেটা পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করি না। কিন্তু অবচেতন মনে সেই স্বভাবটি রয়েই যায়। এই কারণেই, নিজের ভালো একটি ফোন থাকলেও নতুন মডেলের ফোন কিনতে ইচ্ছা করে, বাসায় রান্না করে অনেক কম খরচে খাওয়া যায় জেনেও রেস্টুরেন্টে যেতে ইচ্ছা করে – কারণ পরিচিত মানুষরা সেখানে যাচ্ছে, ফেসবুকে সেল্ফি দিচ্ছে।

সেল্ফির প্রসঙ্গ ধরেই বলি, সোশ্যাল মিডিয়া কিন্তু পুরোটাই ফোমো-মার্কেটিং নির্ভর।

ফেসবুকে আপনি যতই স্ক্রোল করবেন – ততই নতুন নতুন কনটেন্ট আপনার সামনে আসবে। ছবি, স্ট্যাটাস, ভিডিও – আরও কত কি! – আর এই নতুন কনটেন্টের সম্ভাবনাই ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের ফেসবুকে বসিয়ে রাখে। বের হতে মন চায় না, কারণ অবচেতন মন ভাবে, ”বের হলেই হয়তো নতুন কিছু মিস করে ফেলবো”

আবার মানুষ যখন দেখে, বন্ধুর ঘুরতে যাওয়ার ছবিতে শত শত লাইক ও কমেন্ট পড়েছে – তখন তারও ইচ্ছা হয় তেমনটা পেতে। সে হয়তো ঘোরাঘুরি তেমন একটা পছন্দ করে না – কিন্তু লাইক পাওয়ার লোভে ঘুরতে গিয়ে একগাদা ছবি তুলে নিয়ে আসে।

আবার দেখবেন, কিছু মানুষ ফোন হাতে নিয়ে সোফায় বসে পুরো ছুটির দিনটা কাটিয়ে দিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ঘেঁটে। নিজেকে কিভাবে এতে ’প্রেজেন্টেবল’ করা যায়, কিভাবে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায় – এসব নিয়েই বহু মানুষের দিন কাটে। এর ফলে মানুষের মাঝে সম্পর্ক গুলো নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি, প্রতিনিয়ত অন্যের মত হওয়ার জন্য মানুষ চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিজেকে ক্রমাগত ছোট ভাবছে, এবং অন্যকে হিংসা করার মাত্রা বাড়ছে।

গত বছর আমেরিকায় হওয়া ঋণ বিষয়ক একটি গবেষণায় দেখা যায় ১৮-৩৪ বছর বয়সী আমেরিকানদের মধ্যে ৪০% মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘ভালো লাইফস্টাইল’ দেখাতে গিয়ে ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েছেন। – একটি সমাজের জন্য এরচেয়ে ভয়ঙ্কর আর কি হতে পারে?

এই সোশ্যাল মিডিয়া মানুষের যত সময় নষ্ট করছে – পৃথিবীর ইতিহাসে মনেহয় কোনওকিছু এত মানুষের এত সময় নষ্ট করতে পারেনি।

শুধু সোশ্যাল মিডিয়া কেন, ফোন মার্কেট, পোশাকের ব্র্যান্ড থেকে শুরু করে খাবারের ব্র্যান্ড পর্যন্ত এই FOMO মার্কেটিং কাজে লাগিয়ে মানুষের টাকা ও সময় নষ্ট করে ফায়দা লুটছে।

মানুষের হাতে খুব ভালো কাজ করছে এমন একটি আইফোন সেভেন প্লাস থাকার পরও সে দরকার হলে ধার করেও আইফোন টেন কিনছে। কারণ আইফোন টেন না কিনলে কি হারাতে হবে – সেই ভয়ে অস্থির হওয়ার পাশাপাশি সে বন্ধুদের কাছে বা সমাজে ‘ভাব’ ধরে রাখতে চাইছে।

অন্যরা যা জানে, তা জানার আকাংখাও এর অন্তর্গত। মানুষ জন্মগত ভাবেই কৌতুহলী। এই স্বভাব মাঝে মাঝে দুর্বলতাও। যা জানার দরকার নেই, তা জানার জন্যও মানুষ পাগল হয়ে ওঠে – যখন ভাবে, অন্যরা যদি জানে, এবং সে না জানে – তাহলে কি হবে?

এই ভয় এবং কৌতুহলের কারণে মানুষ “অমুক নায়িকাকে নিয়ে একি বললেন তমুক নায়ক!” – টাইপের ভিডিও বা আর্টিকেলে ক্লিক করে। যদিও অমুক নায়িকাকে তমুক নায়ক গুলি করে মেরে ফেললেও তার কিছু যায় আসে না।

হ্যাঁ – যদি জানাটা কাজের হয়, তবে অবশ্যই জানবেন – কিন্তু যা জেনে কোনও লাভ নেই, সেই ফাঁদে পড়ার কোনও মানে হয় না। আপনি যদি বিজ্ঞানের ছাত্র বা গবেষক হন, এবং আপনার ওয়ালে যদি আপনার কাজের বিষয়ে একটি নতুন গবেষণার খবর আসে – আপনি অবশ্যই সেটা পড়তে পারেন। কিন্তু পাশের দেশের কোন নায়কের বিয়ে হওয়ায় কোন নায়িকা তিন দিন ঘর থেকে বের হননি – এটা জানা এমনকি পেশাদার পেশাদার অভিনেতা বা পরিচালকেরও দরকার নেই।

আপনি কি জানেন, সিগারেট থেকে শুরু করে মদ, গাঁজা, ইয়াবা, হিরোইনের মত নেশার শুরু হয় FOMO- এর ফাঁদে পড়ার কারণে?

বিশেষ করে বন্ধুরা যখন সিগারেট বা অন্য নেশা করে – তখন নিজেরও মনে হয়, ওরা যে মজা পাচ্ছে – তা তো আমি মিস করবো; অথবা মনে হয় ‘অভিজ্ঞতা’ নেয়ার দরকার আছে।

বাজে নেশা থেকে শুরু করে, ক্ষতিকর অসামাজিক সম্পর্ক, অতি খরচ – সবই আসলে এই – ‘না করলে কি হবে’, ‘এমন সুযোগ আর পাবো না’, ‘মানুষ কি মনে করবে’, ‘জীবন তো একটাই, এটা না করলে সারাজীবন আফসোস করতে হবে’ – ইত্যাদি মনে হওয়ার ফসল।

এই মনে হওয়া গুলোই FOMOর ফাঁদ – যা আপনার সময় ও অর্থ তো নষ্ট করেই – এমনকি জীবনও ধ্বংস করে দিতে পারে।

FOMO- এর ফাঁদ থেকে বাঁচার উপায়:
সত্যি কথা বলতে এটা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট। যেটা নেই – সেটা সে পেতে চাইবে। অন্যের কিছু থাকলে সেটা পেলে নিজের কেমন লাগবে – এটা ভাববে, এবং পেতে চাইবে।

কিন্তু এটা যখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, অথবা মানুষ যখন বোঝে না – এটা কি, অথবা কিভাবে এবং কেন তার ক্ষতি করছে -তখনই সে ফাঁদে পড়ে যায়।

এর আগের পয়েন্ট গুলোতে আমরা আপনাকে FOMO কি, এবং কিভাবে এটা মানুষের ক্ষতি করে – তা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এখন এটার নিয়ন্ত্রণ ও এই ফাঁদ থেকে বাঁচার কয়েকটি উপায় আপনাকে জানাবো আগামীকাল। এই ভয়ানক ফাঁদ থেকে বাঁচতে চাইলে ফলো করুন আমাদের। কমেন্টস বক্সে জানিয়ে দিন আপনাদের মূল্যবান মতামত।

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy