
ঐতিহ্যবাহী লোকনৃত্য গম্ভীরা, যা এই জেলার লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রতি বছর বৈশাখ মাসে নতুন রূপে ধরা দেয়। দেবাদিদেব মহাদেবের (বুঢ়া) কাছে সমাজের নানা সমস্যা ও অভিযোগ তুলে ধরে মানুষ। হাজার বছরের পুরনো এই ধারাই যেন আজও মালদার মাটিতে প্রতিধ্বনিত হয় গম্ভীরার সুরে।
মালদার গম্ভীরা কেবল একটি উৎসব নয়, এটি এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার দর্পণ। বৈশাখের দিনগুলিতে গম্ভীরার মাধ্যমে মানুষ শিবের কাছে আবেদন জানায়, ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং মুক্তির পথ খোঁজে। পুরনো একটি গম্ভীরার গানের এই পংক্তিগুলি যেন সেই চিরন্তন আর্তিকেই প্রকাশ করে:
“হামরা বছর বছর তোকে পূজিয়া/হে বুঢ়া দিনে দিনে গেনু গতিয়া/সোনার এ গৌড় দেশ, সাজালি ভিক্ষুকের বেশ/ ধনে মানে কোলি শেষ, গাঁজা ফুঁকিয়ে/আনন্দে পোহাত রাত/সোনার থালে খেত ভাত/ সে’দেশেতে দিলি কাভাত ঢুকিয়া/রাজার সন্তান সবে, কাঙ্গাল সেজেছে এবে/(বুঢ়া) এখনও আছিস চোখ বুজিয়া…৷”
প্রাচীন মালদা অঞ্চলের চণ্ডীমণ্ডপকে ‘গম্ভীরি’ বলা হতো এবং গম্ভীরা অর্থ ছিল আরাধনা ও ধর্মীয় গৃহ। কথিত আছে, বৌদ্ধ আমলে এর প্রবর্তন। গম্ভীরা একসময় বৌদ্ধতান্ত্রিক দেবী আদ্যার ভজন-গৃহ হিসেবেও পরিচিত ছিল, যা পরবর্তীকালে শিব উপাসনার সাথে যুক্ত হয়। ‘গম্ভীর’ বা ‘শিব’ শব্দ থেকেই এই লোকশিল্পের নামকরণ বলে গবেষকদের মত। মালদা ও দিনাজপুর সংলগ্ন পৌন্ড্রবর্ধন রাজ্যের অংশ বরেন্দ্রভূমিতে এই শিল্প প্রচলিত ছিল, যেখানে রাজবংশী, দেশিপলি, কোচসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত উৎসব ছিল গম্ভীরা।
গম্ভীরা উৎসবের দুটি প্রধান ধারা – একটি প্রাচীন আচারসর্বস্ব এবং অন্যটি ব্যবহারিক বা প্রদর্শনীমূলক। প্রায় ৫০০-৬০০ বছর আগে গম্ভীরার সঙ্গে গান যুক্ত হয়। আর বর্তমানে প্রচলিত আধুনিক গম্ভীরার ধারাটি প্রায় ২০০ বছর আগে আচার্য বিনয়কুমার সরকার প্রবর্তন করেন। এই ধারায় সং সজ্জা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মাধ্যমে সমাজের বা বছরের বিভিন্ন ঘটনার সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। একসময় সংবাদমাধ্যমের অভাবে গম্ভীরাই সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলি জনগণের সামনে তুলে ধরার মাধ্যম ছিল। এই ধারা আজও বিদ্যমান।
গম্ভীরায় শিবের উপস্থিতি অপরিহার্য, যাকে শিল্পীরা এখন ‘নানা’ নামে ডাকেন। এই ‘নানা’ কখনও রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী বা পাড়ার মোড়লের প্রতীক হন। মানুষ তাদের যাবতীয় সমস্যা ‘নানা’-র কাছে তুলে ধরে এবং তিনি সমাধানের পথ বাতলে দেন। অতীতের গম্ভীরা শিল্পীরা ছিলেন নির্ভীক। তারা সমাজের প্রভাবশালী ও কর্তাব্যক্তিদের অন্যায়-দুর্নীতিকে গানের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরতেন, এমনকি ব্রিটিশ আমলেও এই প্রতিবাদী সত্তা দেখা যেত।
তবে একসময় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই প্রাচীন লোকশিল্প বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। গ্রামের পর গ্রাম থেকে এই শিল্প হারিয়ে যাচ্ছিল, শিল্পীরা পেটের তাগিদে অন্য পেশা বেছে নিচ্ছিলেন। পুরাতন মালদা ছাড়া অন্য কোথাও গম্ভীরা প্রায় হতোই না। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার লোকশিল্পীদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। গম্ভীরা শিল্পীরা সরকারি ভাতা, বিনামূল্যে সরঞ্জাম ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেতে শুরু করেন। এতে শিল্পটি নতুন জীবন পায় এবং মহিলা শিল্পীরাও এতে যুক্ত হন। জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে মালদায় প্রায় ৪৫০ জন গম্ভীরা শিল্পী সরকারি ভাতার আওতায় এসেছেন এবং ২৬টি গম্ভীরা দল সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ফলে গম্ভীরার প্রসার বাড়লেও এর চরিত্র বদলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন শিল্পী ও গবেষকদের একাংশ। তাদের মতে, সরকারি ভাতার নিরাপত্তা হারানোর ভয়ে শিল্পীরা এখন শাসকদল বা প্রশাসনের বিরুদ্ধে সেভাবে মুখ খুলতে সাহস করেন না। গম্ভীরা তার ঐতিহ্যবাহী প্রতিবাদী সত্তা হারাচ্ছে। পুরাতন মালদার কিছু প্রবীণ শিল্পী ও গান রচয়িতার কথায় এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।
বংশপরম্পরায় গম্ভীরার সাথে যুক্ত সঞ্জয় কুণ্ডু জানান, তিনি মূলত তরুণদের নিয়ে কাজ করেন এবং এই শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল দেখছেন। পুরাতন মালদার মানুষের কাছে গম্ভীরা একটি ধর্ম। তিনি বলেন, সরকারি সহায়তার ফলে এই শিল্প টিকে থাকবে। অন্যদিকে, প্রায় তিন দশক ধরে গম্ভীরার গান বাঁধছেন অখিল সাহা। তিনি জানান, এবার তিনি মূলত সামাজিক সমস্যা নিয়ে গান বেঁধেছেন, রাজনীতিকে দূরে রেখেছেন।
নবপ্রজন্মের শিল্পী, সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সঞ্চিতা কুণ্ডু গম্ভীরাকে সমাজকে সচেতন করার মাধ্যম হিসেবে দেখে এবং ‘নানা’ সেজে মানুষের কথা শুনতে ও সমাধানের পথ বাতলাতে তার খুব ভালো লাগে। ৭০ বছর ধরে গম্ভীরা দেখে আসা প্রতাপরঞ্জন গুপ্তও সময়ের সাথে শিল্পের বিবর্তন এবং মেয়েদের অংশগ্রহণকে ইতিবাচক বলে মনে করেন, তবে মানুষের সচেতনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
তবে জেলার সবচেয়ে পুরনো কুতুবপুর গম্ভীরা দলের পরিচালক প্রশান্ত শেঠ সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার সমালোচনা করে বলেন যে এর ফলে শিল্পীদের স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে। শিল্পীরা এখন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে ভয় পান। তিনি মনে করেন, সরকার বিরোধী কিছু বলা যাবে না বলে প্রশাসন থেকে বলে দেওয়া হচ্ছে, যা গম্ভীরার আসল উদ্দেশ্য নষ্ট করছে এবং মানুষও তার প্রকৃত স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিশিষ্ট গম্ভীরা গবেষক সুস্মিতা সোম গম্ভীরার বৌদ্ধতান্ত্রিক মূল এবং সমাজ শাসনের মাধ্যম হিসেবে এর ভূমিকার কথা তুলে ধরে বলেন যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা এই ‘সমাজ শাসনের’ দিকটিকে বাধাগ্রস্ত করছে। শিল্পীরা কার্যত লিখিতভাবে মুচলেকা দিচ্ছেন যে তারা সরকার বিরোধী কিছু বলবেন না, যা লোকশিল্পের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।
তবে তৃণমূল পরিচালিত পুরাতন মালদা পুরসভার চেয়ারম্যান কার্তিক ঘোষ ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, গম্ভীরায় শুধু স্থানীয় নয়, বিশ্বব্যাপী সমস্যার কথাও উঠে আসে। তিনি মনে করেন, গম্ভীরার মাধ্যমে শাসক ও বিরোধী দল উভয়ের কর্মকাণ্ডই বিশ্লেষণ করা উচিত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পীদের সত্তায় হস্তক্ষেপের নির্দেশ দেননি এবং সরকার কাজ করলে ভুল হতেই পারে, যা শিল্পীরা তুলে ধরতে পারেন বলে তিনি মনে করেন। তিনি চান গম্ভীরা তার নিজস্ব সত্তা বজায় রেখে এগিয়ে চলুক।
সব মিলিয়ে, সরকারি সহায়তায় মালদার প্রাচীন লোকসংস্কৃতি গম্ভীরা হয়তো নতুন জীবন পেয়েছে, কিন্তু এর প্রতিবাদী ও সমাজ সমালোচনার ঐতিহ্যবাহী চরিত্র কতটা ধরে রাখতে পারছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।