শ্রীলংকার মতো দেউলিয়াত্বের পথেই কি হাঁটছে উন্নয়নশীল বিশ্ব? কি বলছে বিশেষজ্ঞরা?

আশির দশককে বলা হয় পশ্চিমাদের স্বপ্নের দশক। পশ্চিমা বিশ্ব তখন ফ্যাশন, সঙ্গীতসহ নতুন ধারার জগতে মোহাবিষ্ট। পশ্চিমা অর্থনীতিতেও ব্যাপক অগ্রগতি হয় এ সময়ে। এখনো আশির দশকের সেই স্বর্ণালী সময়কে স্মরণ করে উদযাপন করে পশ্চিমারা। কিন্তু একটু চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকালে উল্টো চিত্র চোখে আসে। আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপ থেকে সরে একটু দক্ষিণে তাকালে ভয়াবহ এক সময় ঘুরপাক খেতে থাকে।

হ্যাঁ, দক্ষিণ আমেরিকার কথাই বলছি। আশির দশককে দক্ষিণ আমেরিকানরা হতাশার দশক, হারানোর দশকই মনে করে। ইংরেজিতে ‘লস্ট ডিকেড।’

আশির দশকে দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। বিশাল ঋণের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়ে যায় অনেক দেশ। এর পেছনের কারণ ছিল বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। আশির দশকে দশকে দুই কারণে তেলের দাম নাগালের বাইরে চলে যায়। এর প্রথম কারণ ছিল আরব-ইসরাইল যুদ্ধ। এ সময় তেলের দাম প্রায় ৩০০% বৃদ্ধি পায়।

দ্বিতীয় কারণ, ইরানি বিপ্লব কিংবা ইরান-ইরাক যুদ্ধ। উচ্চ তেলের দামের কারণে দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। দেশগুলো বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়। যার ফলে পণ্য আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গিয়ে নাগালের বাইরে চলে যায়। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক অবস্থার পতন ঘটে দেশগুলোতে। এদের মধ্যে মেক্সিকো ১৯৮২ সালে নিজেদের প্রথম দেউলিয়া ঘোষণা করে এবং বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কথা জানায়। এরপর একের এক দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলো নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে থাকে। ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, পেরু, ইকুয়েডরসহ মহাদেশের প্রায় সবগুলো দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। দেশগুলো অর্থনৈতিক মন্দার পাশাপাশি উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, বিশাল ঋণের বোঝা, সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে ধীরগতি, বেকারত্ব মতো নানা সমস্যায় জর্জরিত হতে থাকে।

তিন দশক পরে ঠিক একই চিত্র দেখতে যাচ্ছে বিশ্ব? উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে তাকালেই এর আঁচ অনেকাংশেই পাওয়া যায়। উন্নয়নশীল দেশগুলো বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে ব্যাপক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মুখোমুখি হচ্ছে। এদের মধ্যে অতি সম্প্রতি নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করা শ্রীলংকার কথা না বললেই নয়।

শ্রীলংকার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। সামান্য ডলারের রিজার্ভ আর বিশাল বৈদেশিক ঋণে জর্জরিত শ্রীলংকার অর্থনীতি। মানুষের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য নেই কোনো অর্থ। যদিও শ্রীলংকার এই দুরবস্থার জন্য রাজপাকসে সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই মূলত দায়ী। তারা রাষ্ট্রের আয় থেকে ব্যয়ই বেশি করেছে, সঙ্গে বিপুল পরিমাণ কর কমানো অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছে। এছাড়াও বৈশ্বিক অর্থনীতি, রাজনীতি ও করোনা মহামারিতে পথে বসতে হয়েছে শ্রীলংকাকে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দরুণ বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে শ্রীলংকার অর্থনীতিতে। এসব কারণেই মূলত শ্রীলংকা আজ দেউলিয়া। দেশজুড়ে সরকার বিরোধীদের আন্দোলন-অস্থিরতা।

কিন্তু ভয়ের বিষয় হচ্ছে শ্রীলংকার এই অর্থনৈতিক দুরবস্থা আর শ্রীলংকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলংকার মতো অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পতন ঘটতে পারে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতেও। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যুদ্ধের ৯ দিন আগে এ বছরের ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে বিশ্বব্যাংক আশঙ্কা প্রকাশ করে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো বিদেশি ঋণ পরিশোধে ব্যাপক সংকটে পড়তে পারে। বিশ্বব্যাংকের মতে প্রায় ৭০টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের প্রায় ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ বাকি আছে। ঋণ সমস্যা থেকে উত্তরণ না হতে পারলে ভেঙে পড়তে পারে এসব দেশের অর্থনীতি। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ৯ দিন পর বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির ব্যাপক সংকট দেখা দেয়। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়। গত মার্চে জাতিসংঘের একটি রিপোর্টে দেখা যায়, বিশ্বের ১০৭টি দেশের অর্থনীতি বিদ্যমান তিন ধরনের ঝুঁকির কমপক্ষে কোনো একটির সম্মুখীন হচ্ছে।

১. খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি
২. জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি
৩. কঠিন অর্থনৈতিক অবস্থা

১০৭টি দেশ এই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আর এই ১০৭টি দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭০ কোটি। পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। এদের মধ্যে ৬৯টি দেশ সবগুলো ঝুঁকির আওতায় পড়ে। নিকট ভবিষ্যতে এসব দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা হতে পারে অনেকাংশে শ্রীলংকার মতোই। ৬৯টি দেশের মধ্যে আফ্রিকার ২৫টি, এশিয়ার ২৫টি, দক্ষিণ আমেরিকার ১৯টি দেশের নাম তালিকায় সবার আগে।

মিসর
মিসর গমের সবচেয়ে বড় ক্রেতা। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে মিসর বেশিরভাগ গম আমদানি করে; কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এই দুই দেশ থেকে গম আমদানি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। গত মাসে মিসর জানায় তাদের কাছে মাত্র তিন মাসের গমের মজুত আছে।

তিউনিশিয়া
তিউনিশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বেহাল। বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় ৮০ কোটি ডলার, মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে ৭%, জ্বালানির দাম ইতিহাসে সর্বোচ্চ। বিশেষজ্ঞদের মতে, খুব শীঘ্রই তিউনিশিয়ার অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।

লেবানন
২০২২ সালে রাজধানী বেরুতে বিস্ফোরণের কারণে লেবাননের সর্ববৃহৎ খাদ্যশস্যের গুদাম ধ্বংস হয়ে যায়। এ বছর খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে ১১ গুণ। ডলার বিপরীতে লেবাননের পাউন্ড ৯০% মূল্য হারিয়েছে। মাথাপিছু ঋণ আয়ের বিপরীতে বেড়েছে ৩৬০ গুণ। লেবাননের মোট গম আমদানির ৮০% আসে ইউক্রেন থেকে। যুদ্ধের কারণে গম আমদানিতে ভাটা পড়েছে। গমজাত খাদ্যপণ্যের তুমুল সংকট পড়েছে দেশটি। খাদ্যনিরাপত্তায় লেবানন বিশ্বব্যাংক থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সম্প্রতি।

আর্জেন্টিনা
মুদ্রাস্ফীতি আর্জেন্টিনার অর্থনীতিকে অসাড় করে দিচ্ছে। বিদেশি ঋণের বোঝা বাড়ছে প্রতিনিয়তই। এ পর্যন্ত আর্জন্টিনা নিজেদের ৯ বার দেউলিয়া ঘোষণা করেছে।

এলসালভাদর ও পেরু
এই দুই দেশে নিত্যপণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য সংকট, বেকারত্ব বেড়েছে ব্যাপকহারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলংকার পথে হাঁটছে এলসালভাদর ও পেরু। খুব শীঘ্রই দেখা দিতে পারে অস্থিরতা।

আফ্রিকার ঘানা, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে।

ঘানায় বাড়ছে বৈদেশিক ঋণের বোঝা, কেনিয়ার ঋণের পরিমান প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। দক্ষিণ আফ্রিকায় জিডিপির প্রায় ৮০% বৈদেশিক ঋণ।

ইউরো-এশিয়ান রাষ্ট্র তুরস্কও রয়েছে অর্থনৈতিক ঝুঁকির তালিকায়। ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মান কমছে প্রতিনিয়ত। দেশটিতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে প্রায় ৭০%। তুরস্কের জিডিপির ৫৪% বৈদেশিক ঋণ। রয়েছে খাদ্যসংকটও।

বিশ্বব্যাংক বলছে আগামী ১২ মাসে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হতে পারে। এটি এই প্রজন্মের সর্ববৃহৎ ঋণসংকট হিসেবে বিবেচিত হবে।

ভারতে ও বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়ছে। ভারতের পাঞ্জাব, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশের জিডিপি ও ঋণের অনুপাতিক হার অনেকটা শ্রীলংকার মতোই। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মতে, এসব রাজ্যের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা পুরো দেশের অর্থনীতিকে সংকটে ফেলে দিতে পারে।

বাংলাদেশে প্রায় সবধরণের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। ডলার বিপরীতে কমেছে টাকার মান। রিজার্ভ ও ঋণের ব্যাপারে সরকার সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে আগেভাগেই।

এ মুহূর্তে পুরো বিশ্বই ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। রাষ্ট্রগুলো রিজার্ভ খরচে বেশ সাবধানতা অবলম্বন করছে। বিভিন্ন খাতে খরচ কমাতে বাধ্য হচ্ছে। সরকারি কর্মকর্তাদের যত্রতত্র বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দিচ্ছে। আর উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোতেই এ সমস্যা প্রকট।

এখনই উদ্যোগ না নিলে খুব নিকটেই দেখা যাবে শ্রীলংকার মতো অনেক রাষ্ট্রই দেউলিয়া হয়ে পথে বসেছে। এজন্য প্রয়োজন সঠিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। অপ্রয়োজনীয় এবং উচ্চ ঋণের প্রকল্পের থেকে সরে আসা। ঋণ নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকা। অভ্যন্তরীণ কৃষিকে উৎসাহ প্রদান এবং দেশীয় উৎপাদনের ওপর গুরুত্বারোপ করা। তা না হলে উন্নয়নশীল বিশ্ব ব্যাপক আকারে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়তে পারে।

তথ্যসূত্র: টাইমস ও ডব্লিউআইওএন

Related Posts

© 2024 Tech Informetix - WordPress Theme by WPEnjoy