ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর জেরে রাশিয়া এর মধ্যেই নানা ধরনের অভূতপূর্ব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নিষেধাজ্ঞার পরবর্তী নিশানায় রয়েছেন অ্যালিনা কাবায়েভা। কিন্তু, কে এই অ্যালিনা?
অ্যালিনা কাবায়েভার পরিচয় দিতে গিয়ে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে—তিনি একজন রাজনীতিবিদ, গণমাধ্যমের বড় হর্তাকর্তা এবং সাবেক রুশ অলিম্পিক জিমন্যাস্ট। এবং গুঞ্জন সত্যি হলে এই অ্যালিনা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ‘প্রেমিকা’ এবং তাঁর ‘কয়েক সন্তানের মা’।
বিবিসি বলছে, ইইউসহ অন্যান্য দেশের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞাগুলোর উদ্দেশ্য হলো—পুতিনের ঘনিষ্ঠ লোকজনকে শাস্তি দেওয়া। এসব লোকজনের মধ্যে রয়েছেন একদল রুশ ‘অলিগার্ক’ বা ধনকুবের, রাজনীতিবিদসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তারা। বলা হয়ে থাকে, এসব লোকজন পুতিনের সঙ্গে নিজেদের নৈকট্য থেকে লাভবান ও উপকৃত হয়েছেন।
গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য পুতিনের দুই মেয়ে মারিয়া ভোরনসোভা (৩৬) ও কাতেরিনা তিখোনোভার (৩৫) ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। পুতিন ও তাঁর সাবেক স্ত্রী ল্যুডমিলার সন্তান মারিয়া ও কাতেরিনা।
ইইউ’র আসন্ন নিষেধাজ্ঞায় অ্যালিনা?
এখন পর্যন্ত অ্যালিনা কাবায়েভা পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এড়াতে পেরেছেন। ধারণা করা হচ্ছে, অ্যালিনা হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। কেননা, গত মার্চে এক অনলাইন পিটিশনে তাঁকে সুইজারল্যান্ডের বাসভবন থেকে উৎখাতের দাবি করা হয়েছিল।
সূত্রের বরাতে বিবিসি নিশ্চিত করেছে—ইইউ’র আসন্ন নিষেধাজ্ঞার সর্বশেষ তালিকায় অ্যালিনার নাম রয়েছে।
আর, বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, ক্রেমলিনের প্রচার-প্রচারণায় এবং ৬৯ বছর বয়সি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত’ থাকার কারণে অ্যালিনাকে নিশানা করা হচ্ছে। তবে, নিষেধাজ্ঞার খসড়া নথিতে অ্যালিনাকে পুতিনের প্রেমিকা বা বান্ধবী হিসেবে অভিহিত করা হয়নি। এ ছাড়া ইইউ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে ওই নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাবে স্বাক্ষরও করেনি।
রুশ সর্বেসর্বা নেতা ভ্লাদিমির পুতিন বরাবরই ব্যক্তিগত বিষয়ে গভীর গোপনীয়তা অবলম্বন করে আসছেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে, সেসব প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন সব সময়।
তবে, পুতিন অবশ্য অ্যালিনা কাবায়েভার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে ও স্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন।
২০০৮ সালে ‘মস্কোভস্কি করেসপনডেন্ট’ নামের সংবাদপত্র দাবি করে—পুতিন তাঁর স্ত্রী ল্যুডমিলাকে তালাক দিয়ে অ্যালিনা কাবায়েভাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করছেন। পুতিন ও অ্যালিনা দুজনেই সে কথা প্রত্যাখ্যান করেন। এর পরেই রুশ কর্তৃপক্ষ পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। পুতিন ও ল্যুডমিলা ওই ঘটনার পাঁচ বছর পরে বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন।
যখন রুশ প্রেসিডেন্ট অ্যালিনার সঙ্গে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন, সে সময় অ্যালিনা একজন সফল ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব থেকে সফল রাজনীতিকে রূপান্তরের পথ তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন।
‘রিদমিক’ জিমন্যাস্টিকসে কীর্তি
ছন্দময় বা ‘রিদমিক’ জিমন্যাস্টিকস ছিল অ্যালিনার ইভেন্ট। এ ধরনের জিমন্যাস্টিকসে প্রতিযোগীরা ফিতা ও বলের মতো সরঞ্জামের সাহায্যে নিজেদের শারীরিক কৌশল ও দক্ষতা প্রদর্শন করে থাকেন।
অ্যালিনা কাবায়েভাকে তাঁর সময়কার বিশ্বসেরা জিমন্যাস্ট বলে মনে করেন অনেকে। ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার ব্যাটসম্যান তিলকরত্নে দিলশানের নামানুসারে যেমন ‘দিলস্কুপ’ শট পরিচিত, তেমনি ছন্দময় জিমন্যাস্টিকসে অ্যালিনার নামানুসারে একটি বিশেষ ‘মুভ’ রয়েছে। ছন্দময় জিমন্যাস্টিকসে আধিপত্য দেখানো রুশ দলের সেরা পারফরমার ছিলেন অ্যালিনা। রাশিয়া ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল এ ইভেন্টে সবকটি অলিম্পিক স্বর্ণপদক জিতেছে।
অ্যালিনার জন্ম ১৯৮৩ সালে। চার বছর বয়সে রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে হাতেখড়ি অ্যালিনার। তাঁর প্রশিক্ষক ইরিনা ভিনার বলেন, ‘আমি যখন প্রথম ওকে দেখেছিলাম, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে জন্য গুরুত্বপূর্ণ দুটি গুণের বিরল সমন্বয় ছিল মেয়েটির মধ্যে—শারীরিক নমনীয়তা এবং সহজে ও দ্রুত শরীর নাড়াতে পারত অ্যালিনা।’
এরপর অ্যালিনা কাবায়েভা একসময় ‘রাশিয়ার সবচেয়ে (শারীরিকভাবে) নমনীয় নারী’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
অ্যালিনার আন্তর্জাতিক অভিষেক হয় ১৯৯৬ সালে। এবং ১৯৯৮ সালে তিনি সবাইকে অবাক করে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে নেন।
এরপর ২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকে অ্যালিনার সাফল্যের ছন্দপতন হয়। নিজের ইভেন্টে পারফর্ম করার সময় অস্বাভাবিক এক ভুল করেন বসেন অ্যালিনা। সে বছর কেবল ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাঁকে। চার বছর পরে, এথেন্স অলিম্পিকে স্বরূপে ফেরেন তিনি। ওই অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয় করেন অ্যালিনা।
ক্যারিয়ারে মোট ১৮টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ পদক এবং ২৫টি ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপ পদক জিতেছেন অ্যালিনা। এ ছাড়া অলিম্পিক পদক তো রয়েছেই। একাধিক রুশ ক্রীড়াবিদের মতো অ্যালিনার গায়েও ডোপিংয়ের (নিষিদ্ধ মাদক বা ওষুধ গ্রহণ করা) কলঙ্ক লেগেছিল। ডোপ টেস্টে নিষিদ্ধ পদার্থ গ্রহণের প্রমাণ মেলায় ২০০১ সালে একটি ইভেন্টে পদক হারাতে হয়েছিল অ্যালিনাকে।
রাজনীতিতে পদার্পণ
খেলা ছাড়ার পর রাজনীতিতে আসেন অ্যালিনা। তিনি ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টির সদস্য হিসেবে রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে নিজের আসন ধরে রাখেন।
অ্যালিনা ২০১৪ সালে রাশিয়ার ন্যাশনাল মিডিয়া গ্রুপের চেয়ার নির্বাচিন হন। প্রায় সব বড় রুশ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এই ন্যাশনাল মিডিয়ার বড় প্রভাব রয়েছে।
রুশ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ক্রেমলিন-পন্থি বার্তা প্রকাশ করে আসছে। এসব গণমাধ্যম ইউক্রেনীয়দের বিরুদ্ধে নিজেরাই নিজেদের শহরগুলোতে গোলাগুলি চালানোর অভিযোগ করে আসছে। এবং একইসঙ্গে রুশ সেনাদের ‘মুক্তিদাতা’ হিসেবে উপস্থাপন করে আসছে।
বলা হয়ে থাকে, অ্যালিনা তাঁর অবস্থানে বদৌলতে রাশিয়ার অন্যতম ধনী নারী হয়ে উঠেছেন। ফাঁস হওয়া বিভিন্ন নথি থেকে জানা গেছে, অ্যালিনার বার্ষিক আয় এক কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারের কাছাকাছি।
অ্যালিনা ও পুতিনের প্রথম দেখা কবে হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে, একজন শীর্ষস্থানীয় অলিম্পিকজয়ীর সঙ্গে তাঁর দেশের প্রেসিডেন্টের সাক্ষাৎ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। ২০০১ সালে এ জুটির একটি ছবি প্রকাশ পায়। ওই ছবিতে পুতিন অ্যালিনাকে রাশিয়ার শীর্ষ রাষ্ট্রীয় সম্মান ‘অর্ডার অব ফ্রেন্ডশিপ’ পদকে ভূষিত করতে দেখা যায়।
পুতিন-অ্যালিনা জুটির একাধিক সন্তান?
গুঞ্জন রয়েছে—পুতিন-অ্যালিনা জুটির একাধিক সন্তান রয়েছে। যদিও সন্তানের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে।
সুইজারল্যান্ডের একটি সংবাদপত্রের দাবি—অ্যালিনা কাবায়েভা ২০১৫ সালে লুগানো লেকের কাছাকাছি একটি বিশেষ ক্লিনিকে এক ছেলে এবং ২০১৯ সালে একই জায়গায় আরেকটি ছেলে সন্তানেরর জন্ম দিয়েছেন। তবে, সানডে টাইমস ও দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে—২০১৯ সালে মস্কোতে যমজ সন্তানের জন্ম দিয়েছেন অ্যালিনা। অবশ্য অ্যালিনার কয়টি সন্তান, তা নিয়ে গণমাধ্যম দুটির মধ্যে মতদ্বৈধতা রয়েছে।
ক্রেমলিন অবশ্য বরাবরই এসব খবর অস্বীকার করেছে। ২০১৫ সালে পুতিনের মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘ভ্লাদিমির পুতিনের সন্তান জন্মের তথ্য বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।’
পুতিন নিজে জনসমক্ষে কখনও ল্যুডমিলার গর্ভজাত নিজের সন্তানদের নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেননি। কেবল এটুকুই বলেছেন—তাঁর দুটি প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে রয়েছে। পুতিনের যেমন ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় রাখার ধাঁচ, তাতে অ্যালিনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বা সন্তানের বিষয়গুলো নিয়ে জল্পনা অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা যায়।
পুতিনের সঙ্গে সম্পর্কের খবর প্রকাশের পর থেকেই অ্যালিনা প্রায় নিয়মিত গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্টদের নজরে রয়েছেন। কখনও থেকেছেন সরাসরি পাদপ্রদীপের আলোয়, কখনও আবার আলোচনার একটু বাইরে।
২০১১ সালে বিখ্যাত ভোগ ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে আসেন অ্যালিনা। ওই ছবিতে তাঁকে একটি প্রখ্যাত ফরাসি ফ্যাশন হাউসের একটি দামি স্বর্ণখচিত পোশাকে দেখা যায়। অ্যালিনা সোচিতে ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের মশাল বহন করেছিলেন।
অ্যালিনা জনসমক্ষে না এসে লুকিয়ে রয়েছেন বলে কথা উঠেছিল। সেসব গুঞ্জন উড়িয়ে গত মাসেই তিনি মস্কোতে একটি জুনিয়র জিমন্যাস্টিকস ফেস্টিভ্যালে হাজির হন। সেখানে তিনি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। কিছু গণমাধ্যম সে সময় বলেছিল—ওই অনুষ্ঠানে অ্যালিনা বিয়ের ব্যান্ড (আঙটি) পরে এসেছিলেন।
রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকেই অ্যালিনাকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনতে বিভিন্ন পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল বলছে—যুক্তরাষ্ট্র অ্যালিনা কাবায়েভাকে নিষেধাজ্ঞা দিতে অনিচ্ছুক। কেননা, এ ধরনের পদক্ষেপ পুতিন ‘অত্যন্ত ব্যক্তিগত আক্রমণ’ হিসেবে নিতে পারেন এবং চলমান উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের।
যদিও অ্যালিনার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না বলে মনে করছে বিবিসি। কেননা গত মাসে যখন হোয়াইট হাউসের তৎকালীন প্রেস সচিব জেন সাকিকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, কেন অ্যালিনা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় নেই, সাকি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেউই (তালিকায় নাম ওঠা থেকে) নিরাপদে নেই।’