চলতি বছরে টুইটার এবং স্ন্যাপচ্যাটের সম্মিলিত বিজ্ঞাপনের মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে চলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টিকটক। এছাড়া আগামী দুই বছরের মধ্যে চীনা-মালিকানাধীন অ্যাপটি ইউটিউবকে ধরে ফেলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। টিনেজ ও তরুণদের মধ্যে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা পাওয়ায় ইতোমধ্যেই আরেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুক’ এর চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে এই প্ল্যাটফর্মটি।
গুগল-মালিকানাধীন প্রতিদ্বন্দ্বী ইউটিউবের ১২ বছর পর টিকটক চালু হওয়া সত্ত্বেও, ২০২৪ সালের মধ্যে দুটি প্ল্যাটফর্মই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আয় করবে বলে অনুমান বিশেষজ্ঞদের। নাম টিকটক হলেও, অ্যাপটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এটির ধীর-ছন্দের নামকরণকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছে!
গত বছর বৈশ্বিক বিজ্ঞাপনের দিক থেকে স্ন্যাপচ্যাটকে পেছনে ফেলেছিল টিকটক এবং চলতি বছরের মধ্যে এটি টুইটারকেও ছাড়িয়ে যাবে। ধারণা করা হচ্ছে, এবছর বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিজেদের আয় তিন গুণ বৃদ্ধি করে ১১ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে আসবে টিকটক। এদিকে টুইটার ও স্ন্যাপচ্যাটের সম্মিলিত আয় ১০ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলা্র।
ইনসাইডার ইন্টেলিজেন্স এর প্রধান বিশ্লেষক ডেবরা এহো উইলিয়ামসন বলেন, “গত কয়েক দুই বছরে বিস্ফোরক হারে বেড়েছে টিকটক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। শুধু তাই নয়, ব্যবহারকারীরা এই অ্যাপটিতে যে পরিমাণ সময় দেন তা সত্যিই অকল্পনীয়! গানে ঠোঁট মেলানো এবং নাচের জন্য পারফেক্ট অ্যাপ হিসেবে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে এটি। এটি নানা ধরনের ট্রেন্ড তৈরি করে এবং ক্রিয়েটরদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে। ফলে একের পর এক ভিডিও আসতে থাকায় ব্যবহারকারীরা সারাক্ষণই টিকটকের সাথে যুক্ত থাকেন।”
প্রতিষ্ঠার চার বছর পর, ২০২১ সালে বিলিয়ন ব্যবহারকারীর মাইলফলক স্পর্শ করে টিকটক। বিলিয়ন ব্যবহারকারীতে আসতে ফেসবুক-ইউটিউব বা ইনস্টাগ্রামের যে সময় লেগেছিল, টিকটকের লেগেছে তার অর্ধেক! ম্যাসেজিং অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের চাইতেও তিন বছর আগেই এই অর্জন নিজেদের ঝুলিতে পুরেছে টিকটক। ডেটা.এআই এর বিশ্লেষকদের অনুমান, চলতি বছরে মাসিক দেড় বিলিয়ন অনুসারীর রেকর্ড গড়বে টিকটক।
প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে একটি ‘সুইট স্পট’ তৈরি করেছে টিকটক। বিশেষ করে ১৮-২৫ বছর বয়সী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে টিকটকের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু ঠিক এই বয়সের ব্যবহারকারীর সংখ্যা সবচেয়ে হ্রাস পেয়েছে ফেসবুকের। তবে নিজেদের আরেক সহপ্রতিষ্ঠান ইনস্টাগ্রামের মাধ্যমে এই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে মেটা।
বর্তমানে টিনেজ ও তরুণদের মধ্যে টিকটক ব্যবহার অনেকটা নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিডিয়া নিয়ন্ত্রক অফকম. এর গবেষণা বলছে, ১৩ বছরের কম বয়সীদের জন্য টিকটক নিষিদ্ধ করা হয়েছে দাবি করলেও, ৩-৪ বছর বয়সী শিশুরাও দেখছে টিকটকের কন্টেন্ট। ৫-৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে টিকটক ব্যবহারের এই মাত্রা আরও ২৯ শতাংশ বেশি।
ডেটা.এআই আরো জানিয়েছে, গেল বছর টিকটক ব্যবহারকারীরা প্রতি মাসে গড়ে ১৯.৬ ঘন্টা সময় ব্যয় করেছেন এই অ্যাপটির পেছনে যা ২০১৮ সালের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি। সময় ব্যয়ের দিক থেকে এটি ফেসবুকের সমান।
এ প্রসঙ্গে পারফরমেন্স মার্কেটিং কোম্পানি অ্যাফিজ-এর চীফ মার্কেটিং অফিসার স্যাম ও’ব্রিয়েন বলেন, “ব্যবহারকারীর আধিপত্যের দিক থেকে সবসময়ই এগিয়ে ছিল ফেসবুক। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, টিকটকের অনুগত ব্যবহারকারীদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হবে ফেসবুককে। কারণ ব্যবহারকারীদের কিভাবে নেশার মতো আটকে রাখা যায়, সে উপায় পেয়ে গেছে টিকটক!”
তবে বিশ্ববাজারে এখনো পর্যন্ত নিজের আধিপত্য ধরে রেখেছে মার্ক জাকারবার্গের ফেসবুক। এই মুহূর্তে ফেসবুকের মাসিক সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন এবং ইনস্টাগ্রামের ২ বিলিয়ন। ইনসাইডার ইন্টেলিজেন্স বলছে, ২০২৪ সালে বিজ্ঞাপন থেকে ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে যথাক্রমে ৮৫ বিলিয়ন ডলার এবং ৮২ বিলিয়ন ডলার। যদিও গত মাসে শোনা গিয়েছিল, টিকটকের আধিপত্যের ভয়ে আলাদা একটি লবিং ফার্ম ভাড়া করেছে ফেসবুক এবং তারা টিকটককে ‘হুমকিজনক বিদেশি মালিকানাধীন অ্যাপ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।
ও’ব্রিয়েন বলেন, “মেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে যে তারা টিকটকের বিরুদ্ধে একটি লড়াইয়ে দাঁড়িয়ে। মহামারি আরম্ভের পর থেকেই বিস্ময়করভাবে বেড়েছে টিকটক ব্যবহারকারীর সংখ্যা। ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ফেসবুক।”
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে জনসাধারণের মনে ধারণা দেওয়া হয় যে, হুয়াওয়ে থেকে শুরু করে টিকটকের প্যারেন্ট কোম্পানি বাইটডান্সসহ অন্যান্য চীনা কোম্পানি ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য বেইজিংয়ে পাচার করছে। আর এই সন্দেহকেই এখন কাজে লাগাতে চাইছে মেটা।
বছর দুয়েক আগে বিশ্বের সবচেয়ে বড় একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী দেশ ভারত নিজ দেশে ৫৯টি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ করে, যার মধ্যে টিকটকও ছিল। এদিকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চেয়েছিলেন, বাইটডান্স যেন মাইক্রোসফট বা ওরাকলের মতো কোনো মার্কিন প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেদের আন্তর্জাতিক সেবা স্বত্ব বিক্রি করে দেয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের পর সে পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তবে ট্রাম্প হেরে গেলেও তার ছড়ানো সন্দেহ দূর হয়নি যুক্তরাজ্যসহ আরও কিছু দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মন থেকে। গত বছর এক গবেষণায় দেখা যায়, এক তৃতীয়াংশ ব্রিটিশ নাগরিক মনে করেন, টিকটক তাদের ব্যক্তিগত তথ্য চীনা সরকারের কাছে পাচার করে দিতে পারে।
এদিকে দেশের টেক জায়ান্টদের উপর চীনা সরকারের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হওয়ায় চাপের মুখে পড়েছিল বাইটডান্সও। গত বছরের মে মাসে অপ্রত্যাশিতভাবে বাইটডান্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা ঝ্যাং ইমিং জানান, তিনি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। এরপর বাইটডান্স নিজেদের প্রতিষ্ঠানকে ছয়টি ইউনিটে বিভক্ত করে এবং পুরো কাঠামো ঢেলে সাজায়। কিন্তু তারপরেও গত নভেম্বরে চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন ইমিং।
কিন্তু এতসব ঝড়ঝাপ্টা সত্ত্বেও টিকটক তার নিজ গতিতে এগিয়ে গেছে। ৩৫৩ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্য নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইউনিকর্ন কোম্পানির খেতাব লাভ করে টিকটক। চীনের অভ্যন্তরে কার্যক্রম, ইন-অ্যাপ এবং ই-কমার্স ব্যবসা মিলিয়ে ২০২১ সালে বাইটডান্সের আয় ২০২০ সালের চেয়ে ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়!
অন্যদিকে, বৃহৎ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া মেটার আয় গত বছর ৩৭ শতাংশ বেড়ে ১১৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়। কিন্তু টিকটকের সাথে পাল্লা দিতে এবং নিজের বিজ্ঞাপনভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলে বৈচিত্র্য আনতে নতুন কিছু উদ্ভাবনের প্রয়োজন বোধ করেন জাকারবার্গ।
এই মুহূর্তে ‘জাক বাকস’ নামে এক ধরনের ভার্চুয়াল কয়েন বাজারে আনার সুযোগ খুঁজছে মেটা। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীরা এই ভার্চুয়াল কয়েন কিনতে ও ব্যবহার করতে পারবেন, যা ইতোমধ্যেই টিকটকের একটি জনপ্রিয় কৌশল হিসেবে পরিচিত।
চলতি সপ্তাহে জানা গেছে, ইন-অ্যাপ পারচেজ হিসেবে এই মুহূর্তে টিকটকই রয়েছে চাহিদার শীর্ষে। বছরের প্রথম তিন মাসেই টিকটক ব্যবহারকারীরা এর ভার্চুয়াল কয়েনের পেছনে ৮৪০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছেন। ক্রিয়েটরদের ‘টিপ’ দিতে এবং ভিডিওর প্রচারণা চালাতে এই কয়েন ব্যবহার করা যায়।
টিকটককে পুরোপুরি নকল করে ‘ল্যাসো’ নামক একটি অ্যাপ ২০১৮ সালে চালু করেছিলেন জাকারবার্গ। কিন্তু মাত্র ১৮ মাস পরেই এটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে সংক্ষিপ্ত ভিডিও ও রিলস যোগ করার মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছে মেটা। কিন্তু তা সত্ত্বেও টিকটকের জনপ্রিয়তায় কোনো ভাঁটা পড়তে দেখা যায়নি।
এন্ডারস-এর সিনিয়র মিডিয়া বিশ্লেষক জেমি ম্যাকএওয়ান বলেন, “তরুণদের কেউ কেউ ইতোমধ্যেই ফেসবুক চালানো বন্ধ করে দিয়েছেন। যুক্তরাজ্যে ১৮-২৪ বছর বয়সীরা ফেসবুক-ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ মিলিয়ে যে পরিমাণ সময় দেন, শুধু টিকটকেই সেই পরিমাণ সময় দেন তারা। মানুষ কোথায় কতটা সময় দিবে তা নিয়ে এখন তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। টিকটকই এখন সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অ্যাপ।”