অ্যাডাম রেইনার। নামটি ইতিহাসে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান দখল করে আছে। অ্যাডাম বিশ্বের একমাত্র ব্যক্তি যিনি জন্মেছিলেন বামন আকৃতি নিয়ে কিন্তু মৃত্যুর সময় তার আকৃতি ছিল বিশাল। এমনকি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডের সবচেয়ে পরিবর্তনশীল উচ্চতার খেতাব অর্জন করেন তিনি। কীভাবে অ্যাডাম মাত্র ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি থেকে ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি হয়েছিলেন সেই গল্পই আজ জানা যাক।
অ্যাডাম রেইনারের জন্ম ১৮৯৯ সালে অস্ট্রিয়ার গ্রাজ শহরে। তার পিতামাতা দুজনই ছিলেন স্বাভাবিক গড় উচ্চতাসম্পন্ন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে অ্যাডাম সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে যান। কিন্তু উচ্চতার কারণে বাদ পড়তে হয় তাকে। সেসময় অ্যাডামের উচ্চতায় ছিল মাত্র ৪ ফুট ৬ ইঞ্চি। ডাক্তাররা তার উপর কয়েকটি পরীক্ষা চালায়। একজন কর্মঠ ও উদ্যম সৈন্য হবার পক্ষে তাকে ছোট এবং দুর্বল বলে বাদ দেওয়া হয়।
পরের বছর আবার সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য যান। তখন তার বয়স ১৯ বছর। উচ্চতা বেড়েছে আরও ২ ইঞ্চি। কিন্তু সেবারও তাকে বাদ পড়েন অ্যাডাম। তবে এখানে এসে তিনি একটি উপাধি পান। সেনাবাহিনীর চিকিৎসকরা অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তাকে বামন গোত্রীয় বলে বিবেচিত করে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ৪ ফুট ৮ ইঞ্চির উচ্চতা নিয়েও রেইনার বামন উপাধি পান।
তবে পরীক্ষার পর চিকিৎসকরা বেশ আশ্চর্য হয়েছিলেন একটি বিষয়ে। সেটি হচ্ছে অ্যাডামের উচ্চতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম হলেও তার শরীরের হাত এবং পা অস্বাভাবিক রকমের বড় ছিল। প্রথমবার সেনাবাহিনীতে যখন অ্যাডাম পরীক্ষা দেয় তখন তার জুতার মাপ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিসেবে ১০ এবং ইউরোপের হিসেবে ৪৩ সাইজের। তিন বছরের ব্যবধানে তার পায়ের মাপ হয়ে দাঁড়ায় দ্বিগুণ। ২০ এবং ৫৩ সাইজের জুতোর দরকার হয় তার তিন বছরের পার্থক্যে। অবশ্য সেই সময়টাতে তার উচ্চতা তুলনামূলকভাবে স্থিরই ছিল বলা চলে।
সবকিছু বদলে যেতে থাকে অ্যাডাম ২১ বছর বয়সে পা দেওয়ার পর থেকেই। অ্যাডাম আরও দুই ইঞ্চি বৃদ্ধি পায়। ব্যাপারটা মোটেও অস্বাভাবিক নয়; বরং আশাব্যঞ্জক বলা চলে। ১৯২০ সালেও অ্যাডাম লম্বায় মোটামুটি কম ছিলেন স্বাভাবিকের চেয়ে এবং শারীরিকভাবে ছিলেন দুর্বল, ক্ষীণ আর দেখতেও কৃশকায় বা হাড্ডিসার। সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বাড়তে শুরু করে। তার এই অনবরত বাড়ন্তের বিষয়টা এতটাই দ্রুতগতির আর চলমান ছিল, চিকিৎসকরা ব্যাপারটাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। এরকমভাবে চলমান জীবনে অ্যাডাম এক দশক পরে প্রায় দুই ফিট বেড়ে যায় উচ্চতায়। তার উচ্চতা তখন গিয়ে ঠেকে সাত ফিট এক ইঞ্চিতে। চিকিৎকরা একদম হতভম্ব হয়ে যায়।
চিকিৎসকরা নানান পরিক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকে অ্যাডামের। কিছুতেই এর কারণ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ১৯৩০-১৯৩১ সাল পর্যন্ত ডা. এ. ম্যান্ডল এবং এফ. উইন্ডহোলজ রেইনারকে পরীক্ষা করেন। শুরুতেই তারা এটি যে সাধারণ কোনো হরমোনের প্রভাবে হচ্ছে না তা বুঝতে পেরেছিলেন। শেষে জানা যায়, অ্যাডাম এমন একটা ব্যধিতে ভুগছেন যেটা অ্যাক্রোম্যাগেলি নামে পরিচিত।
অ্যাক্রোম্যাগেলি এমন একটি রোগ যা শরীরের বাড়ন্ত হরমোনের অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে হয়ে থাকে। ফলে হাত-পা এমনকি দৈহিক গড়ন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায় বয়সের তুলনায়। অ্যাক্রোম্যাগেলি মূলত একটি বিরল রোগ। রেইনারের ক্ষেত্রে, তার পিটুইটারি গ্রন্থিতে একটি টিউমার হবার কারণে এমনটা হচ্ছিল। টিউমারটার জন্য তার শরীরের বাড়ন্ত হরমোন পরিমাণের চাইতে বেশি উৎপাদন করছিল।
রেইনারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণ ছিল এটাই। এই বিরল রোগের ক্ষেত্রে যেটা হয় যে, রোগীর হাত-পা অস্বাভাবিক হারে বড় হয়ে যায়। তবে রেইনারের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা শুধু হাত আর পা এবং দৈহিক গড়নেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কপাল এবং চোয়ালের বাড়ন্ত হাড়ের কারণে তার মুখমন্ডলও ব্যাপক প্রসারিত হচ্ছিল। তার ঠোঁট পুরু হয়ে গিয়েছিল এবং দাঁত থেকে দাঁতের দূরত্ব বেড়ে গিয়েছিল দ্বিগুণ। বাড়ন্ত হাড়ের কারণে তার মেরুদণ্ডজনিত সমস্যাও প্রকটরূপে দেখা দিয়েছিল। তার ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির কারণে মেরুদণ্ড বাড়তে বাড়তে একসময় তা বাঁকাতে শুরু করে জায়গা সংকুলান না হওয়াতে।
দশ বছর ধরে বেড়ে উঠা টিউমারটি অপসারণ করতে সক্ষম হন চিকিৎসকরা। এরপরের কয়েক মাসে তার উচ্চতা এক বিন্দুও বাড়েনি। তবে তাতে খুশি হতে পারেননি চিকিৎসকরা। কারণ তার মেরুদণ্ড যে বাড়ন্ত হাড়ের কারণে বেঁকে গিয়েছিল তা এখন বেশ সমস্যায় ফেলেছে তাকে।
ধীরে ধীরে অ্যাডামের শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। প্রথমে তিনি তার শ্রবণশক্তি হারান। তারপর একচোখের দৃষ্টিশক্তি। সেই সঙ্গে মেরুদণ্ড বেঁকে যাওয়ার সমস্যা তো রয়েছেই। ফলে হাঁটাচলা কিংবা বসে থাকাও ছিল খুবই কষ্টের। একসময় বিছানায় শুয়ে থাকা শুরু হয়। ১৯৫০ সালে মাত্র ৫১ বছর বয়সে মারা যান তিনি। তখন তার উচ্চতা ছিল ৭ ফুট ৮ ইঞ্চি। আবার কোথাও কোথাও বলা হয় ৭ ফুট ১০ ইঞ্চি।
সূত্র: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড, অল দ্যাট ইন্টেরেস্টিং